বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

উদ্দেশ্য পূরণ না হলে মানতের বিধান কেমন?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:২২ পিএম

শেয়ার করুন:

উদ্দেশ্য পূরণ না হলে মানতের বিধান কেমন?

শরিয়তের পরিভাষায় মানত হলো ‘কোনো মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান প্রযোজ্য) ব্যক্তির নিজের ওপর এমন কোনো কাজ আবশ্যক করা, যা শরিয়ত প্রণেতা আবশ্যক করেননি’ (আল-ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবায়া: ২/৭৭৯)। কোনো ব্যক্তির ওপর মানত আবশ্যক হওয়ার শর্ত  হলো—সাবালক হওয়া, জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া এবং এখতিয়ার বা ইচ্ছাধিকার থাকা। (আল-ফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবায়া: ২/৭৭৯)

মানত শুদ্ধ হওয়ার জন্য ইসলামি আইনজ্ঞরা আরো কিছু শর্তারোপ করেন। যেমন—নেক কাজের মানত করা, বান্দার সাধ্যের ভেতর হওয়া, নিজের মালিকানাধীন হওয়া, পাপের কারণ বা উপলক্ষ না হওয়া ইত্যাদি।


বিজ্ঞাপন


মানতের বিধান
মানত করলে তা পূরণ করা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানত পূর্ণ করে এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন ঘরের’ (সুরা হজ: ২৯)। অন্য আয়াতে মুমিনের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়েছে এভাবে—‘তারা মানত পূর্ণ করে এবং সেদিনের ভয় করে, যেদিনের বিপত্তি হবে ব্যাপক।’ (সুরা দাহর: ৭)

তবে, পাপ কাজের মানত করলে তা পূরণ করা আবশ্যক নয়। হানাফি মাজহাব অনুসারে, তখন কাফফারা দেওয়া আবশ্যক হবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্যের মানত করে সে যেন তাঁর আনুগত্য করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার মানত করে, সে যেন তাঁর অবাধ্য না হয়। (আবু দাউদ: ৩২৮৯)

আরও পড়ুন: ইসলাম জাত-বর্ণের পার্থক্য করে না

মৃত ব্যক্তির মানত পূরণের ক্ষেত্রে তার আত্মীয়-স্বজনের দায়িত্ব হলো মৃতের পক্ষ থেকে তা পূরণ করে দেওয়া। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী (স.)-এর কাছে এক লোক এসে বলল যে, আমার বোন হজের মানত করেছিল, কিন্তু সে মারা গেছে। তখন নবী (স.) বললেন, তার ওপর কোনো ঋণ থাকলে তবে কি তুমি তা আদায় করতে না? লোকটি বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, কাজেই আল্লাহর হককে আদায় করে দাও। কেননা আল্লাহর হক আদায় করা আরো বড় কর্তব্য। (সহিহ বুখারি: ৬৬৯৯)


বিজ্ঞাপন


বহুদিন আগের মানতও পূরণ করা আবশ্যক। দেরি হয়েছে বলে মানত পূরণ না করার সুযোগ নেই। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি জাহেলি যুগে মসজিদুল হারামের ভেতর এক রাত ইতেকাফ করার মানত করেছিলাম। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমার মানত পূরণ করো। (সহিহ বুখারি: ২০৩২)

সাধারণত যে জিনিসের মানত মানা হয়, সেটাই আদায় করতে হবে, যদি তা আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ কাজ হয়ে থাকে (বুখারি, মেশকাত: ৩৪২৭)। সমমানের অন্য বস্ত্ত দিয়েও আদায় করা যাবে না। তবে, হ্যাঁ, ব্যক্তির জন্য কষ্টসাধ্য হলে বিকল্প জিনিস দ্বারা মানত পূরণ করা বৈধ হবে, যদি বিকল্প জিনিসটি মূলের চেয়ে উত্তম হয়। যেমন— জাবির বিন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মক্কা বিজয়ের দিন এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর জন্য মানত করেছি যে, আল্লাহ যদি আপনাকে মক্কায় বিজয়ী করেন তবে বায়তুল মুকাদ্দাসে দুই রাকাত নামাজ আদায় করব। নবী (স.) বলেন, তুমি এখানেই নামাজ আদায় করো। লোকটি তার কথার পুনরাবৃত্তি করল। তিনি বললেন, তুমি এখানে নামাজ আদায় করো। লোকটি আবারও তার কথার পুনরাবৃত্তি করল। নবী (স.) বললেন, এই ব্যাপারে তোমার স্বাধীনতা আছে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৩০৫)

মানত পূরণের জন্য কখনো শরিয়তের সীমা অতিক্রম করা যাবে না। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যদি সোমবার রোজা রাখার মানত করে এবং সেদিন ঈদ হয়, তবে সে সর্বসম্মতিক্রমে রোজা রাখবে না।’ (শরহুন নববি: ৮/১৬)

আরও পড়ুন: দারিদ্র্য দূর করে যে সুরা 

মানতের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের ওপর কোনো অতিরিক্ত কষ্ট চাপিয়ে নেবে না। কেননা নিজেকে কষ্ট দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে তার দুই ছেলের ওপর ভর করে হেঁটে যেতে দেখে বললেন, তার কী হয়েছে? তারা বলল, তিনি পায়ে হেঁটে হজ করার মানত করেছেন। রাসুল (স.) বললেন, লোকটি নিজেকে কষ্ট দিক আল্লাহ তাআলার এর কোনো দরকার নেই। অতঃপর তিনি তাকে সওয়ার হয়ে চলার জন্য আদেশ করলেন। (সহিহ বুখারি: ১৮৬৫)

উদ্দেশ্য পূরণ না হলে কী করবেন?
উদ্দেশ্য পূরণ না হলে মানত আদায় করতে হবে না। (এমদাদুল আহকাম: ৩/২৯, ফতোয়ায়ে ফকিহুল মিল্লাত: ৭/৩৮২) কেননা রাসুল (স.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই সকল আমল নিয়তের উপরে নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তা-ই হবে, যার সে নিয়ত করেছে।’ (বুখারি, মুসলিম, মেশকাত: ১)

মানতের কাফফারা
মানত পূরণ না করলে ব্যক্তি কাফফারা দেবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মানতের কাফফারা কসমের কাফফারার মতো’ (সুনানে নাসায়ি: ৩৮৩৪)। কসমের কাফফারা সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর এর কাফফারা ১০ জন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাবার দেওয়া—যা তোমরা তোমাদের পরিবারকে খেতে দাও, অথবা তাদেরকে কাপড় দান করা কিংবা একজন দাস মুক্তি। যার সামর্থ্য নেই তার জন্য তিন দিন রোজা পালন করা।’ (সুরা মায়েদা: ৮৯; মুসলিম, মেশকাত: ৩৪২৯)

মনে রাখতে হবে, শরিয়ত মানতকে বৈধ বললেও নিরুৎসাহ করেছে। রাসুলুল্লাহ (স.) মানত করতে নিষেধ করেছেন। কেননা তা মানুষের কোনো কল্যাণ করতে পারে না। এর মাধ্যমে কেবল কৃপণ ব্যক্তি থেকে সম্পদ বের করা হয়। (সুনানে নাসায়ি: ৩৮০১)। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মানতের বিধি-বিধান বুঝার ও যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর