সাধারণত মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, পোষ্য, পরিচারক সবাই মিলে পরিজন। মানুষের কাছে দয়া ও ভালবাসার মতো মানবিক গুণাবলী বিকাশের সর্বোত্তম জায়গা হল একটি পরিবার। পরিজনের প্রতি দায়িত্ব পালন কিংবা তাদের জন্য ব্যয়ভার বহন, ভরণ-পোষণ ইসলামে বাধ্যতামূলক।
একইভাবে পৃথিবীতে আল্লাহ তাআলার কিছু পরিজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (স.)। আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, কিছু মানুষ আল্লাহর পরিজন। সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল, তারা কারা? তিনি বলেন, কোরআন তেলাওয়াতকারীরা আল্লাহর পরিজন এবং তাঁর বিশেষ বান্দা।’ (ইবনে মাজাহ: ২১৫)
বিজ্ঞাপন
কোরআনের ধারক-বাহকরা আল্লাহ তাআলার এমন পরিজন, যাদেরকে জান্নাতে তো দাখিল করানো হবেই, উপরন্তু তাদের সুপারিশে ১০ জন নিশ্চিত জাহান্নামিকে জান্নাত দেওয়া হবে। হজরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে এবং তা হিফজ বা মুখস্থ করে অতঃপর কোরআন যা হালাল করেছে সে নিজের জন্য তা হালাল করে এবং কোরআন যা হারাম করেছে সে নিজের জন্য তা হারাম করে, তবে কাল কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং নিজ পরিবারের এমন ১০ জনের জন্য তার সুপারিশ কবুল করবেন, যাদের জন্য জাহান্নাম আবশ্যক হয়ে গিয়েছিল।’ (তিরমিজি: ৫/২৯০৫)
পবিত্র কোরআন মহান আল্লাহর বাণী ও সর্বশেষ ঐশী গ্রন্থ। কোরআনের জ্ঞান ও তার তেলাওয়াতের তাওফিক আল্লাহর অনন্য নিয়ামত। তাঁরা পৃথিবীতে সর্বোত্তম ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। কেননা রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে নিজে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ (সহিহ বুখারি: ৫০২৮)
আরও পড়ুন: সৎকাজের আদেশ ও অন্যায়ে বাধা দোয়া কবুলের অন্যতম শর্ত
যারা কোরআন শিখবে এবং সে মতে আমল করবে, কোরআন হিফজ করবে, কেয়ামতের দিন তাদের বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে নবী (স.) বলেছেন, কোরআন কেয়ামত দিবসে হাজির হয়ে বলবে, হে আমার প্রভু, একে (কোরআনের বাহককে) অলংকার পরিয়ে দিন। তারপর তাকে সম্মান ও মর্যাদার মুকুট পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তাকে আরো পোশাক দিন।
বিজ্ঞাপন
সুতরাং তাকে মর্যাদার পোশাক পরানো হবে। সে আবার বলবে, হে আমার প্রভু, তার প্রতি সন্তুষ্ট হোন। কাজেই তিনি তার ওপর সন্তুষ্ট হবেন। তারপর তাকে বলা হবে, তুমি একেক আয়াত পাঠ করতে থাকো এবং ওপরের দিকে উঠতে থাকো। এমনিভাবে প্রতি আয়াতের বিনিময়ে তার একটি করে সওয়াব (মর্যাদা) বাড়ানো হবে। (তিরমিজি: ২৯১৫)
দুনিয়াতেও কোরআনের ধারকরা মর্যাদার শীর্ষে। কেননা কেবল তারাই ইমাম হওয়ার যোগ্য। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও কেরাতে অধিক পারদর্শী ব্যক্তি মানুষের ইমামতি করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৫৮২)
ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) সালিম ইবনে মাকাল (রা.)-এর ব্যাপারে বলেন, ‘যদি সালিম বেঁচে থাকত, তবে আমি শুরা (পরামর্শ সভা) গঠন করতাম না’ (কিতাবু আদাবিল কাজি, পৃষ্ঠা-৬৩০)। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত শুরার হাতে না তুলে দিয়ে সালিম (রা.)-এর হাতে তুলে দেওয়া হতো। আর সালিম (রা.) ছিলেন কোরআন হিফজ ও চর্চায় বেশি আগ্রহী। রাসুলুল্লাহ (স.) মদিনায় আসার আগে সালিম (রা.) কুবায় মুসলিমদের নামাজের ইমামতি করতেন।
আরও পড়ুন: জাহান্নামের আগুন থেকে পরিবারকে বাঁচাবেন যেভাবে
পবিত্র কোরআন হিফজ করা, চর্চা করা এতটাই ফজিলতপূর্ণ কাজ যে, রাসুল (স.) কোরআন হিফজকারীদেরকে ফেরেশতাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আয়েশা (রা.) নবী (স.) থেকে বর্ণনা করেছেন, কোরআনের হাফেজ-পাঠক-লিপিকর সম্মানিত ফেরেশতাদের মতো। খুব কষ্টকর হওয়া সত্ত্বেও যে বারবার কোরআন পাঠ করে, সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে। (বুখারি: ৪৯৩৭)
নবীজি (স.) সাহাবায়ে কেরামকে কোরআনের ধারক-বাহকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। যারা ৩০ পারা কোরআন হেফজ করে তা ধরে রাখে, তার ওপর আমল করে, তারাও সেই সম্মানের যোগ্য। আবু মুসা আল-আশআরি (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (আবু দাউদ: ৪৮৪৩)
কেয়ামতের দিন কোরআনের ওপর আমলকারীদের মা-বাবাকেও সম্মানিত করা হবে। সাহল ইবনু মুআজ আল-জুহানি (রহ.) থেকে তার পিতা থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোরআন পাঠ করে এবং তা অনুযায়ী আমল করে, কেয়ামতের দিন তার মা-বাবাকে এমন মুকুট পরানো হবে যার আলো সূর্যের আলোর চেয়েও উজ্জ্বল হবে। ধরে নাও, যদি সূর্য তোমাদের ঘরে বিদ্যমান থাকে (তাহলে তার আলো কিরূপ হবে?)। তাহলে যে ব্যক্তি কোরআন অনুযায়ী আমল করে তার ব্যাপারটি কেমন হবে, তোমরা ধারণা করো তো!’ (আবু দাউদ: ১৪৫৩)
অতএব আমাদের উচিত, সম্ভব হলে নিজেই কোরআন হেফজ শুরু করা, তা সম্ভব না হলে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা, হাফেজে কোরআনকে সম্মান করা এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে কোরআনে হাফেজ বানানোর চেষ্টা করা। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে সেই তাওফিক দান করুন। আমিন ।