হিংসা একটি ভয়াবহ আত্মিক রোগ। এটি দেহেরও ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। বলা হয়ে থাকে যে, হিংসুক মানুষের কোনো বিশ্রাম (ঘুম) নেই এবং সে বন্ধুর লেবাসে একজন শত্রু। হিংসা হিংসুককেই প্রথমে হত্যা করে। তাকে তিলে তিলে ক্ষয় করে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘..বলে দাও, তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মরো..।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১৯)
হিংসা আল্লাহর জিকির থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং সর্বোপরি অন্যান্য নেক আমল এবং দীন-ধর্মও ধ্বংস করে দেয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ইরশাদ করেন, 'তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো কেননা হিংসা নেক আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে (ধ্বংস করে দেয়) যেমন আগুন কাঠখণ্ডকে খেয়ে ফেলে (জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়)।' (সুনানে আবি দাউদ: ৪৯০৩)
বিজ্ঞাপন
হিংসা-বিদ্বেষ জান্নাতে প্রবেশের অন্তরায়। তাই মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জান্নাত দেওয়ার আগে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে তাদের অন্তরকে পবিত্র করবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর আমি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ বের করে ফেলব, তারা সেখানে ভাই ভাই হয়ে আসনে মুখোমুখি বসবে।’ (সুরা হিজর: ৪৭)
অতএব জান্নাতে যেতে চাইলে আগে থেকেই পরিশুদ্ধ অন্তর অর্জনের চেষ্টা করতে হবে। জান্নাতি লোকের বৈশিষ্ট্যই হলো তার জীবনে কোনো হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। কেননা এটি জান্নাতি লোকের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘প্রথম যে দল জান্নাতে প্রবেশ করবে তারা পূর্ণিমার চাঁদের উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে প্রবেশ করবে আর তাদের পর যারা প্রবেশ করবে তারা অতি উজ্জ্বল তারার মতো আকৃতি ধারণ করবে। তাদের অন্তরগুলো এক ব্যক্তির অন্তরের মতো থাকবে। তাদের মধ্যে কোনো রকম মতভেদ থাকবে না আর পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের প্রত্যেকের দুজন করে স্ত্রী থাকবে। সৌন্দর্যের কারণে গোশত ভেদ করে পায়ের মজ্জা দেখা যাবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করবে। তারা রোগাক্রান্ত হবে না, নাক ঝাড়বে না, থুথু ফেলবে না। তাদের পাত্রসমূহ হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের আর চিরুনিসমূহ হবে স্বর্ণের। তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধি কাঠ।’ (সহিহ বুখারি: ৩২৪৬)
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর দরবারে (মসজিদে নববিতে) উপবিষ্ট ছিলাম। তখন তিনি বললেন, তোমাদের নিকট এখন এক জান্নাতি মানুষ আগমন করবে। (বর্ণনাকারী বলেন) অতপর একজন সাহাবি আগমন করলেন। তাঁর দাড়ি থেকে সদ্যকৃত অজুর পানির ফোটা ঝরে পড়ছিল। তিনি তার বাম হাতে জুতা নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। তার পরদিনও নবী (স.) আমাদেরকে অনুরূপ কথা বললেন এবং প্রথমদিনের মতো সেই সাহাবি আগমন করলেন। যখন তৃতীয় দিন হলো, নবী কারিম (স.) সেই কথা আবারও বললেন এবং যথারীতি সেই সাহাবি পূর্বের অবস্থায় আগমন করলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) যখন আলোচনা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তখন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) সেই সাহাবির অনুগামী হলেন। তিনি তাঁকে বললেন, আমি আমার পিতার সঙ্গে ঝগড়া করে শপথ করেছি, তিনদিন পর্যন্ত তার ঘরে যাব না। এই তিনদিন আমাকে যদি আপনার ঘরে থাকার সুযোগ করে দিতেন, তবে আমি থাকতাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ, থাকতে পারো।
বর্ণনাকারী আনাস (রা.) বলেন, হজরত আবদুল্লাহ (রা.) বলতেন, তিনি তার সঙ্গে সেখানে সেই তিন রাত অতিবাহিত করলেন। তিনি তাকে রাতে উঠে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেও দেখলেন না। তবে তিনি যখন ঘুমাতেন, বিছানায় পার্শ্ব পরিবর্তন করতেন তখন আল্লাহর জিকির করতেন। হজরত আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, তার মুখ থেকে কিন্তু ভালো কথা ছাড়া কোনো মন্দ কথা শুনিনি। যখন তিনদিন অতিবাহিত হয়ে গেল এবং তার আমলকে সাধারণ ও মামুলি মনে করতে লাগলাম, তখন তাকে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা! আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে আপনার সম্পর্কে তিনবার একথা বলতে শুনেছি যে, এখনই তোমাদের নিকট একজন জান্নাতি মানুষ আগমন করবে। উক্ত তিনবারই আপনি আগমন করেছেন। তাই আমি ইচ্ছা করেছিলাম আপনি কী আমল করেন তা দেখতে আপনার নিকট থাকব। যাতে আমিও তা করতে পারি। আপনাকে তো বেশি আমল করতে দেখিনি। তাহলে কোন গুণ আপনাকে এই মহান মর্যাদায় উপনীত করেছে, যা রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন?
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: যে তিন অভ্যাস থাকলে জাহান্নাম নিশ্চিত
তিনি বললেন, তুমি যা দেখেছ, ওই অতটুকুই। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, যখন আমি ফিরে আসছিলাম তখন তিনি আমাকে ডাকলেন। তারপর বললেন, আমার আমল বলতে ওই অতটুকুই, যা তুমি দেখেছ। তবে আমি আমার অন্তরে কোনো মুসলমানের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করি না এবং আল্লাহ তাআলা কাউকে কোনো নেয়ামত দান করলে সেজন্য তার প্রতি হিংসা রাখি না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বলেন, এ গুণই আপনাকে এত বড় মর্যাদায় উপনীত করেছে। আর সেটাই আমরা করতে পারি না। (মুসনাদে বাজজার: ১৯১৮; আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৮/৭৪; আততারগিব ওয়াত তারহিব: ৫/১৭৮)
উক্ত হাদিসে আগন্তুক জান্নাতি সাহাবির নাম অনুচ্চারিত হলেও মূলত তিনি ছিলেন বিখ্যাত সাহাবি হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), যিনি জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির একজন। এখানে তাঁর বিশেষ একটি গুণ ও অনুপম স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের কথা আলোচনা করা হয়েছে। হাদিসে মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় আগন্তুক সাহাবিকে ‘একজন আনসারি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে তা পরবর্তী কোনো বর্ণনাকারীর ভুল। কারণ অন্যান্য বর্ণনাসূত্রে স্পষ্টভাবেই হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর নাম উল্লেখ রয়েছে।
নবীজি (স.) সাহাবায়ে কেরামকে এক জান্নাতি সাহাবির কথা বলে নেককার মানুষের প্রশংসার মাধ্যমে সৎকর্ম ও উত্তম আচরণের প্রতি জোর তাকিদ দিয়েছেন এবং তাদেরকে সেই মহৎ স্বভাব ও বিশেষ গুণ অর্জন করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। তাই মুমিনদের করণীয় হলো—মুত্তাকি ও নেককার লোকদের আমল আগ্রহ ও মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা এবং অনুসরণ-অনুকরণের নিমিত্তে সেই গুণ অর্জন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করা। প্রয়োজনে তাদের নিকট অবস্থান করে তাদের সান্নিধ্য গ্রহণ করা। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তারা ছিলেন এমন লোক যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন। সুতরাং তুমিও তাদের পথের অনুসরণ করো। (সুরা আনআম: ৯০)
হাদিসের সুস্পষ্ট বক্তব্য, যা সহজেই বোধগম্য, তা হলো—আত্মশুদ্ধি করা, অন্তরকে পাক-পবিত্র রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ ও অন্যান্য আত্মার ব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা হচ্ছে এমন একটি গুণ, যা মানুষকে সফলতার শীর্ষ চূড়ায় নিয়ে যায়, তথা জান্নাত লাভের উপযোগী বানায়। এজন্যই রাসুল (স.) হজরত আনাস (রা.)-কে বলেছেন, ‘হে বৎস! কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা ব্যতীত তুমি যদি সকাল-সন্ধ্যা অতিবাহিত করতে (জীবন কাটাতে) সক্ষম হও, তাহলে তাই করো।’
আরও পড়ুন: দুনিয়াতেও শাস্তি পেতে হয় অহংকারী ব্যক্তিকে
অতএব, একজন ইমানদারের জন্য নিজেকে হিংসামুক্ত রাখা জরুরি। প্রয়োজনে সেজন্য দোয়া করতে হবে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে আল্লাহ তাআলা সেই প্রার্থনাও শিখিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, 'আর (তুমি বলো, আমি আশ্রয় চাই) হিংসুকের অনিষ্ট থেকে, যখন সে হিংসা করে।' (সুরা ফালাক: ৫)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিজেকে পবিত্র রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।