শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ঢাকা

দুনিয়াতেই জান্নাতের সুখবর পাওয়া এক ধনী

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩ আগস্ট ২০২২, ০৪:০৫ পিএম

শেয়ার করুন:

দুনিয়াতেই জান্নাতের সুখবর পাওয়া এক ধনী

হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন একজন ধনী সাহাবি। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত ১০ সাহাবির মধ্যে অন্যতম। তৃতীয় খলিফা নির্বাচনের জন্য ওমর (রা.) ছয় সদস্যবিশিষ্ট শুরা কমিটি গঠন করেন, ওই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)। তাঁর এক স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন জাইনাব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর বোন উম্মে হাবিবা বিনতে জাহাশ (রা.)। সেই হিসেবে সম্পর্কে রাসুল (স.)-এর ভায়রা হন তিনি। ইসলামের প্রথম পর্বে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছেন আবদুর রহমান (রা.) তাঁদের একজন।  

এছাড়াও তিনি কোরআন-হাদিসের জ্ঞানে পরিপূর্ণ, পরামর্শ দানে বিজ্ঞ, বিচার ফয়সালার ক্ষেত্রে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ফতোয়াদানে অভিজ্ঞ। তাই প্রথম তিন খলিফাই তাঁকে বিশেষ মর্যাদার আসন দান করেছিলেন। হজরত আবু বকরের খিলাফতকালে ৮জন বিশিষ্ট সাহাবিকে ফতোয়াদান ও বিচার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। হজরত আব্দুর রহমান ছিলেন ওই ৮জনের একজন। হজরত আবু বকর (রা.) অন্তিম শয়ানে তাঁকে ডেকে একান্তে হজরত ওমরকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়নের জন্য পরামর্শ করেন। হজরত ওমর (রা.) তাঁর খেলাফতকালে হজরত আব্দুর রহমানকে বিশেষ পরামর্শকের মর্যাদা দান করেন। তিনি যখন রাতের বেলায় একাকী মদিনাবাসীর অবস্থা পরিদর্শনে বের হতেন, মাঝেমধ্যে হজরত আব্দুর রহমানকে সঙ্গে নিতেন। খলিফা হজরত ওমর (রা.) সাহাবায়ে কেরামের ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জিযিয়া ও খারাজি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এবং আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 


বিজ্ঞাপন


হজরত ওমর (রা.) আবু লুলু কর্তৃক ছুরিকাহত হয়ে যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন তিনি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের যে বোর্ড গঠন করে গিয়েছিলেন, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ ছিলেন ওই বোর্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি তাঁর নিজের দাবি ত্যাগ করে উসমান(রা.)-কে খলিফা নির্বাচনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মসজিদে নববির ইমামতিসহ খলিফার যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি হজরত উসমানের খেলাফতকালে খলিফার মজলিসে শুরার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ইসলামি খেলাফত ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তিদের অন্যতম হলেও ধন-সম্পদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র লালসা ছিল না। তিনি খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করতেন। ধৈর্যশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাকওয়া এবং দায়িত্বনিষ্ঠতা তাঁর চরিত্রে এনে দিয়েছিল এক বিশেষ ঔজ্জ্বল্য। 

আরও পড়ুন: জান্নাতের সুখবর পাওয়া ১০ সাহাবির বৈশিষ্ট্য

সামান্য পুঁজিতে সেরা ব্যবসায়ীতে পরিণত হন আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)। তাঁর বন্ধু সাআদ (রা.) নিজ সম্পদের অর্ধেক এবং দুই স্ত্রীর একজনকে তালাক দিয়ে তাঁকে দিয়ে দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। আবদুর রহমান তাতে সম্মত হলেন না; বরং বন্ধুকে মোবারকবাদ জানিয়ে ব্যবসার পথ বেছে নিলেন এবং ক্ষুদ্র পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। কিছু অর্থ জমা হওয়ার পর বিয়ে করলেন। মহর দিলেন খেজুরের আঁটি সম-ওজন স্বর্ণ। রাসুল (স.)-এর নির্দেশে কিছুদিন পর অলিমা করলেন।

তাঁর ব্যবসা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হলো। মক্কার উমাইয়া ইবনে খালফের সঙ্গে একটি ব্যবসায়িক চুক্তিও সম্পাদন করেন। সামান্য ঘি ও পনির কেনাবেচার মাধ্যমে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। কালক্রমে তিনি তৎকালীন মুসলিম উম্মাহর একজন সেরা ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। (আত তাবকাতুল কুবরা; ৩/৯৩; আল-ইসাবাহ: ৪/২৯১)


বিজ্ঞাপন


ইসলামের পথে অকাতরে দান করতেন তিনি। একদা তিনি রাসুল (স.)-এর  জীবদ্দশায় নিজের সমুদয় সম্পদের অর্ধেক সদকা করেন। এরপর ৪০ হাজার দিনার সদকা করেন। এরপর ৫০০ ঘোড়া আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য প্রস্তুত করে দেন। এরপর ৫০০ উট। এসব তাঁর ব্যবসায় অর্জিত সম্পদ। কথিত আছে, এক দিনেই তিনি ৩০টি দাস আজাদ করেছেন। মৃত্যুকালে তিনি বদরি সাহাবিদের জন্য জনপ্রতি ৪০০ দিনারের অসিয়ত করে যান। তখন ১০০ বদরি সাহাবি জীবিত ছিলেন। সবাই ৪০০ দিনার করে লাভ করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৭/১৬৩; আল-ইসাবাহ:৪/২৯১, ২৯৩)

একবার উসমান (রা.)-এর কাছে একখণ্ড জমি বিক্রি করেন। মূল্য বাবদ ৪০ হাজার দিনারের মালিক হন। সব দিনার তিনি  সাধারণ অভাবী লোক, বনু জুহরার গরিব-মিসকিন ও উম্মুল মুমিনিনদের মধ্যে বণ্টন করে দেন। (আত তাবকাতুল কুবরা: ৩/৯৮)

আরও পড়ুন: পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত একমাত্র সাহাবি

একবার তাঁর বিশাল এক বাণিজ্য কাফেলা ৭০০ উট বোঝাই করা চানাবুট, আটা ও অন্যান্য মুদিসামগ্রী নিয়ে মদিনায় প্রবেশ করে। বিশাল এই বাণিজ্য কাফেলা মদিনাজুড়ে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ খবর আয়েশা (রা.)-এর  কাছে পৌঁছার পর তিনি বলেন, আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, আবদুর রহমান হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবদুর রহমান এ কথা শোনামাত্রই আম্মাজান আয়েশা (রা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, আমি আপনাকে সাক্ষ্য করে বলছি, আমার এ বিশাল বাণিজ্য কাফেলা ও সমস্ত পণ্য, এমনকি উট ও তার হাওদাসহ সব কিছুই মহান আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দিলাম। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৭/১৬৪)

বদর, উহুদ, খন্দক, হুনাইনসহ প্রায় সকল যুদ্ধে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) অসামান্য অবদান রেখেছেন, বীরবিক্রমে যুদ্ধ করেছেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন। ইবনে হাজারের মতে, উহুদের দিন তিনি সারা শরীরে মোট ৩১টি আঘাত প্রাপ্ত হন। রাসুল (স.) ও তাঁর পরিবারের জন্য আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ছিলেন সর্বদা মুক্তহস্ত। 

রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তাবুক অভিযানকালে একদিন আল্লাহর রাসুল (স.) ফজরের সময়ে প্রাকৃতিক প্রয়োজন মিটাতে বাইরে গেলে ফিরে আসতে বিলম্ব হয়। এদিকে সূর্যোদয়ের সময় নিকটবর্তী হয়ে এলে আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) সমবেত সাহাবিদের অনুরোধে ইমাম হয়ে নামাজ শুরু করে দেন। এক রাকাত শেষে রাসুলুল্লাহর উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি পেছনে সরে আসতে চাইলে রাসুল (স.) তাঁকে নিজ স্থানে থাকতে ইশারা করেন এবং তাঁর পেছনে ইকতেদা করে রাসুল (স.) নামাজ আদায় করেন। ষষ্ঠ হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (স.) 'দুমাতুল জানদালে' একটি অভিযান পরিচালনা করেন। এ অভিযানে আব্দুর রহমান ইবনে আউফকে আমির নিযুক্ত করা হয় এবং আল্লাহর রাসুল (স.) নিজ হাতে তাঁকে পাগড়ি পরিয়ে দেন। 

আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) একবার বন্ধুদের দাওয়াত দিলেন। ভালো ভালো খাবার পরিবেশন করা হলো। খাবার দেখে তিনি অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন, আল্লাহর রাসুল (স.) বিদায় নিয়েছেন। তিনি নিজের ঘরে যবের রুটিও পেট ভরে খেয়ে যেতে পারেননি। রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর সম্পর্কে বলতেন, আব্দুর রহমান আসমান ও জমিনের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। 

আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাসুলুল্লাহ (স.) থেকে সরাসরি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকে তাঁর পুত্রগণ, যেমন ইবরাহীম, হুমায়েদ, ওমার, মুসয়াব, আবু সালামা, তাঁর পৌত্র মিসওয়ার, ভাগ্নে মিসওয়ার ইবন মাখরামা এবং ইবন আব্বাস, ইবন উমার, জুবাইর, জাবির, আনাস, মালিক ইবন আওস (রা.) প্রমুখ সাহাবিগণ হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর বড় পরিচয়, তিনি আশারায়ে মুবাশশারার একজন। তিনি হজরত উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে ৩২ হিজরিতে ৭৫ বছর বয়সে মতান্তরে ৭২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। হজরত উসমান অথবা জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) তাঁর জানাজায় ইমামতি করেন এবং মদিনার 'জান্নাতুল বাকী' গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর