বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

সবসময় মৃত্যুচিন্তা মাথায় আসা কি স্বাভাবিক?

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:২৬ পিএম

শেয়ার করুন:

সবসময় মৃত্যুচিন্তা মাথায় আসা কি স্বাভাবিক?

মৃত্যু অনিবার্য সত্য। তাই অন্তরে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। কোরআন ও হাদিসে মৃত্যুচিন্তাকে গুনাহ থেকে বাঁচার এবং নেক কাজের জন্য প্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে অতিরিক্ত বা অবিরাম মৃত্যুচিন্তা, যা দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করে, তা ইসলাম অনুৎসাহিত এবং চিকিৎসাযোগ্য বলে বিবেচনা করে। তাই মৃত্যুচিন্তার স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক রূপের পার্থক্য বোঝা জরুরি।

মৃত্যুচিন্তা: স্বাভাবিক ও ঈমানি অনুভূতি

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী।’ (সুরা আনকাবুত: ৫৭) অন্য আয়াতে উল্লেখ আছে, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন, মৃত্যু তোমাদের স্পর্শ করবেই।’ (সুরা নিসা: ৭৮) এই নিশ্চিত বাস্তবতা মুমিনকে দুনিয়ার মোহ হ্রাস করতে সহায়তা করে এবং জীবনকে সার্থকভাবে কাটানোর প্রেরণা দেয়।

নবী কারিম (স.) মৃত্যুর স্মরণ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা বেশি পরিমাণে জীবনের স্বাদ হরণকারীর অর্থাৎ মৃত্যুর স্মরণ কর।’ (তিরমিজি: ২৩০৭) সাহাবায়ে কেরামও মৃত্যুর স্মরণে যত্নশীল ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলতেন, ‘যখন সন্ধ্যায় উপনীত হবে তখন সকালের জন্য অপেক্ষা করো না… আর তোমার মৃত্যুর জন্য জীবিতাবস্থায় পাথেয় জোগাড় করে নাও।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪১৬) এই স্মরণ মানুষকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে এবং নেক আমলে উদ্বুদ্ধ করে।

মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু মৃত্যুকামনা নয়

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদের স্পর্শ করবেই।’ (সুরা নিসা: ৭৮) ইসলাম মৃত্যুকামনাকে কখনো অনুমোদন করে না। নবী কারিম (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন কিছুতেই মৃত্যু প্রত্যাশা না করে এবং মৃত্যু আসার আগে মৃত্যুর জন্য দোয়াও না করে। কেননা যখন তোমাদের কেউ মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়। আর মুমিনের দীর্ঘ জীবন শুধু তার জন্য কল্যাণই বয়ে আনে।’ (মুসলিম: ৬৯৯৫)


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: মৃত্যুর আগে মানুষ যা দেখে ও অনুভব করে

আত্মহত্যাও ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। হাদিসে এসেছে, ‘যে লোক পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে, সে জাহান্নামের আগুনে পুড়বে, চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর ওভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে লোক বিষপানে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোক লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের আগুনের ভিতর সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে।’ (সহিহ বুখারি: ৫৭৭৮) ইসলাম চায়, মৃত্যুচিন্তা যেন হতাশা বা আত্মসমর্পণের মাধ্যম না হয়ে আত্মশুদ্ধি ও নেক কর্মের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

মৃত্যুচিন্তা ও মানসিক স্বাস্থ্যের ইসলামি স্বীকৃতি

মৃত্যুচিন্তা সাধারণত ঈমানের নিদর্শন হলেও কারও কারও ক্ষেত্রে এটি ভয়, উদ্বেগ বা প্যানিক আক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে। ইসলাম এ ধরনের মানসিক চাপকে বাস্তব সমস্যা হিসেবে স্বীকার করে। রাসুলুল্লাহ (স.) দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে আশ্রয় চাই।’ (সহিহ বুখারি: ২৮৯৩) অতিরিক্ত ভয় বা উদ্বেগ দূর করা সুন্নাহর অংশ এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা নেওয়াও ইসলামি নির্দেশনার অন্তর্ভুক্ত।

মৃত্যুর ভয় নয়, প্রস্তুতির অনুপ্রেরণা

মৃত্যুর সময় অনিশ্চিত। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘কেউ জানে না সে আগামীকাল কী উপার্জন করবে এবং কোথায় তার মৃত্যু হবে।’ (সুরা লোকমান: ৩৪) মুমিনকে প্রতিটি মুহূর্তকে তার শেষ মুহূর্ত মনে করে জীবনযাপন করতে হবে। ইবনে রজব (রহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন, মানুষের প্রতিটি মুহূর্ত যেন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতির মুহূর্ত। 

আরও পড়ুন: মৃত্যুকে ভুলে থাকার ৭ মারাত্মক ক্ষতি

মুমিনের মৃত্যুর প্রস্তুতি

মৃত্যুর প্রস্তুতি মূলত সুস্থ, ন্যায়নিষ্ঠ এবং নেক জীবন গঠনের মধ্যেই নিহিত। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগমনের আগে গনিমত মনে করো। বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দরিদ্রতার আগে সচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ততার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ৩৫৪৬০) তিনি আরও বলেন, ‘অন্ধকার রাতের মতো ফিতনা আসার আগেই নেক আমলের প্রতি অগ্রসর হও।’ (তিরমিজি: ২১৯৮)

সুন্দর মৃত্যুর জন্য বিশেষ করণীয়গুলো হলো-

  • কোরআন তেলাওয়াত
  • অধিক জিকির
  • নিয়মিত সদকা
  • রাতে তাহাজ্জুদ
  • মৃত্যুর আগে ওসিয়ত করা 
  • পাপ হয়ে গেলে দ্রুত তাওবা করা
  • সর্বোত্তম মৃত্যুর জন্য দোয়া
  • ইবাদতের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা
  • অপমৃত্যু থেকে আল্লাহর কাছে পরিত্রাণ চাওয়া

ইসলামের ব্যালান্স: স্মরণ থাকবে, আতঙ্ক নয়

স্বাভাবিক মৃত্যুচিন্তা মানুষকে আত্মশুদ্ধি, নেক আমল এবং সময়ের সদ্ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করে। তবে অবিরাম বা ভয়-জাগানো মৃত্যুচিন্তা, ঘুম ও খাওয়া নষ্ট করা, ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা বা একাকীত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।

আধ্যাত্মিক সমাধান হিসেবে সুরা মুলক, ওয়াকেয়া ও ইয়াসিন তেলাওয়াত করা, রাতে আয়াতুল কুরসি ও তিন কুল পাঠ, জিকির-ইস্তেগফার বৃদ্ধি করা, পরিবারের সঙ্গে সংযোগ রাখা এবং আলেমের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত কার্যকর। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর উপর ভরসা করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক: ৩) অতএব, মৃত্যুচিন্তা মুমিনের জন্য আত্মশুদ্ধির অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত, ভীত বা হতাশার কারণ নয়।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর