জাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি অপরিহার্য ফরজ ইবাদত। পবিত্র কোরআনে বহু স্থানে নামাজের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে জাকাত শুধু আদায় করলেই হয় না, শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষ খাত ও যোগ্যপাত্রেই তা প্রদান করতে হয়। অন্যথায় জাকাত আদায় হবে না। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, জাকাত দেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি কারা? বিশেষ করে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কাদেরকে জাকাত দেওয়া যায় এবং কাদের যায় না? এ প্রতিবেদনে কোরআন-হাদিস ও ফিকহের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের আলোকে সেই বিস্তারিত দিকনির্দেশনা উপস্থাপন করা হলো।
জাকাতের নির্ধারিত খাত
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে জাকাত বণ্টনের ৮টি সুনির্দিষ্ট খাত উল্লেখ করেছেন- ‘জাকাত তো কেবল ফকির, মিসকিন, তৎসংগ্রহকারী (আমিল) এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন, তা (দাসমুক্তিতে) এবং ঋণগ্রস্তদের জন্য, আর আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা: ৬০)
সুতরাং, নিম্নোক্ত যেকোনো এক বা একাধিক শ্রেণির যোগ্য ব্যক্তিকে জাকাতের মালিক বানিয়ে দিতে হবে-
১. ফকির: যার কিছুই নেই বা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য সম্পদ আছে।
২. মিসকিন: যার সম্পদ আছে কিন্তু তা নিসাব পরিমাণ (৫২.৫ তোলা রূপার মূল্যের সমতুল্য) পর্যন্ত পৌঁছায় না।
৩. আমিল: জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মী।
৪. মুয়াল্লাফাতুল কুলুব: নওমুসলিম যাদের ইসলামের প্রতি অনুরাগ বাড়ানো প্রয়োজন।
৫. দাসমুক্তি: ক্রীতদাস বা বন্দী মুক্ত করার জন্য।
৬. ঋণগ্রস্ত: যে ব্যক্তি ঋণে জর্জরিত এবং ঋণ মিটিয়ে দিলে তার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকে না। (ব্যক্তিগত ঋণ এই খাতের অন্তর্ভুক্ত, তবে শিল্প বা ব্যবসায়িক ঋণ জাকাতের হিসাব থেকে বাদ দেওয়া যায় না।)
৭. ফি সাবিলিল্লাহ: আল্লাহর পথে জিহাদ বা দ্বীনি শিক্ষা ও সেবামূলক প্রকল্পে নিয়োজিত ব্যক্তি।
৮. মুসাফির: ভ্রমণরত অবস্থায় অর্থাভাবে পড়ে যাওয়া ব্যক্তি।
আরও পড়ুন: শ্বশুর-শাশুড়িকে জাকাত দেওয়া যাবে?
আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে জাকাতের বিধান
আত্মীয়দেরকে জাকাত দেওয়া শুধু জায়েজই নয়, বরং অধিক সওয়াবের কাজ। তবে সব আত্মীয়কে দেওয়া যায় না। তাদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
১. যাদেরকে জাকাত দেওয়া যায় ও অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম
নিজের ভাই-বোন, চাচা-মামা-ফুফু-খালা, ভাতিজা-ভাগনে, চাচাতো-মামাতো ভাইবোন প্রমুখ নিকটাত্মীয় যদি জাকাতের উপযুক্ত হন (অর্থাৎ নিসাবের মালিক না হন), তাহলে তাদেরকে জাকাত দেওয়া যায় এবং অগ্রাধিকার দেওয়া ওয়াজিব। কারণ হাদিসে এসেছে, আত্মীয়কে দান করলে দুটি সওয়াব: দান করার সওয়াব এবং আত্মীয়তার হক আদায়ের সওয়াব।’ (জামে তিরমিজি: ৬৫৮; মুসনাদে আহমদ: ১৬২৩৩)
২. যাদেরকে জাকাত দেওয়া জায়েজ নেই
কয়েকটি বিশেষ সম্পর্কের আত্মীয়কে জাকাত দেওয়া শরিয়তে নিষিদ্ধ। তারা হলেন-
উর্ধ্বতন আত্মীয়: যেমন- পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানি প্রমুখ।
অধস্তন আত্মীয়: যেমন- ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি প্রমুখ।
স্বামী-স্ত্রী: একে অপরকে জাকাত দিতে পারবে না।
বনু হাশেম (রাসুল (স.)-এর বংশধর)।
আরও পড়ুন: আপন বোনকে জাকাত দেওয়া যাবে?
৩. অন্যান্য আত্মীয় যাদেরকে জাকাত দেওয়া যায়
শ্বশুর-শাশুড়ি সহ অন্যান্য আত্মীয় যারা উপরোক্ত নিষিদ্ধ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নন এবং যারা জাকাতের শর্তপূরণকারী (গরিব, মিসকিন ইত্যাদি), তাদেরকে জাকাত দেওয়া সম্পূর্ণ জায়েজ।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা ও ভুল ধারণা নিরসন
জাকাতের মালিকানা: জাকাতের টাকা অবশ্যই গরিবের ব্যক্তিগত মালিকানায় দিতে হবে। মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ, রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল বা সেতু তৈরির মতো গণউপকারী কাজে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না, কারণ সেখানে কোনো নির্দিষ্ট গরিব ব্যক্তিকে মালিক বানানো হয় না। (তাতারখানিয়া: ৩/১৯৮, ২০৮)
নিয়ত: মনে নিয়ত করলেই যথেষ্ট, মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়।
সামগ্রী ক্রয় করে দেওয়া: জাকাতের টাকা দিয়ে কাপড় বা প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে দিলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে।
শিল্পঋণ: কারো ব্যক্তিগত নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে, তা থেকে শিল্প বা ব্যবসায়িক ঋণ বাদ দেওয়া যাবে না। উক্ত সম্পদেরই জাকাত দিতে হবে। (আলমাবসুত, সারাখসি: ৩/৮, ১১; রদ্দুল মুহতার: ২/৩৪৬)
জাকাত সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য ও সামাজিক সমঝোতা রক্ষার একটি মহান ব্যবস্থা। সঠিক খাতে ও সঠিক ব্যক্তিকে জাকাত প্রদান করলে যেমন ইবাদত কবুল হয়, তেমনি গরিব আত্মীয়কে অগ্রাধিকার দিলে দ্বিগুণ সওয়াব অর্জন করা যায়। তাই জাকাত দেওয়ার সময় উপযুক্ত হকদার চিহ্নিত করা এবং আত্মীয়তার বিধান সামনে রাখা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব।
তথ্যসূত্র: ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, আদদুররুল মুখতার, রদ্দুল মুহতার, আলবাহরুর রায়েক, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ও অন্যান্য প্রামাণিক ফিকহি গ্রন্থ।

