শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

দরুদ শরিফের আধ্যাত্মিক শক্তি ও প্রভাব

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:১৫ পিএম

শেয়ার করুন:

দরুদ শরিফের আধ্যাত্মিক শক্তি ও প্রভাব

দরুদ শরিফ এমন এক রূহানি ইবাদত, যা মুমিনকে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয়নবী (স.)-এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে। এটি কেবল নবীর প্রতি অভিবাদন নয়; বরং কোরআন ও সহিহ হাদিসে প্রতিষ্ঠিত এক বিশেষ আমল, যার মাধ্যমে মানুষের অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, দোয়া কবুলের পথ সহজ হয় এবং জীবনে আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হতে থাকে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় উম্মাহর বুজুর্গ ও আলেমগণ এ আমলের আধ্যাত্মিক শক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা আজও মানুষের জীবনে কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হয়।

দরুদের ঐশি ভিত্তি

দরুদ শরিফের আধ্যাত্মিক শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস হলো পবিত্র কোরআন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতারা নবীর ওপর দরুদ পাঠ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর ওপর দরুদ পাঠ কর এবং সালাম জানাও।’ (সুরা আহজাব: ৫৬)

এই আয়াত দরুদকে সাধারণ কোনো আমল হিসেবে নয়, বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি আদেশ ও তাঁর নিজের করণীয়র সাথে যুক্ত একটি বিশেষ ইবাদত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। আল্লাহ যখন কোনো ইবাদত নিজেও করেন এবং ফেরেশতাদের মাধ্যমে তা অব্যাহত রাখেন, তখন তার মূল্য যে কত উচ্চ, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

সহিহ হাদিসে দরুদের ফজিলত আরও সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দরুদ পাঠ করে, আল্লাহ তার ওপর দশবার রহমত বর্ষণ করেন, দশটি গুনাহ মিটিয়ে দেন এবং দশটি মর্যাদায় উন্নীত করেন।’ (সুনান নাসায়ি: ১২৯৭)
অন্য হাদিসে এসেছে- ‘যখন তোমরা দোয়া করবে, প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করবে, তারপর আমার ওপর দরুদ পাঠ করবে, এরপর দোয়া করবে।’ (তিরমিজি: ৩৪৭৭)

এ থেকে স্পষ্ট হয়, দরুদ শুধু সওয়াব অর্জনের মাধ্যমই নয়; বরং এটি দোয়া কবুলের প্রস্তুতি এবং আধ্যাত্মিক গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম চাবিকাঠি।


বিজ্ঞাপন


আরও পড়ুন: দরুদের কারণে যেভাবে গায়েবি সাহায্য আসে

রাসুল (স.)-এর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কের রাস্তা

দরুদ শরিফ পাঠ করার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে মুমিনের এক বিশেষ হৃদ্যতা ও আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- ‘তোমাদের দরুদ আমার কাছে পৌঁছানো হয়।’ (আবু দাউদ: ২০৪১) আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘কেয়ামতের দিন আমার নিকটতম ব্যক্তি সে-ই হবে, যে আমার ওপর সবচেয়ে বেশি দরুদ পাঠ করেছে।’ (তিরমিজি: ৪৮৪)
এসব ঘোষণায় নবীর নৈকট্য অর্জনের বাস্তব পথ নির্দেশিত হয়েছে এবং নবীজির মনোযোগ লাভের একটি রূহানি বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী পুরস্কার। 

দরুদের বহুমুখী আধ্যাত্মিক প্রভাব

দরুদ শরিফ অন্তরের রোগ ও নফসের দুষণ দূর করার এক অনন্য রূহানি উপায়। ধারাবাহিকভাবে দরুদ পাঠের মাধ্যমে হৃদয়ের কঠোরতা দূর হয়, অহংকার ও হিংসার মতো নফসের ব্যাধি নিয়ন্ত্রিত হয় এবং হৃদয়ে নুরানিয়াত সৃষ্টি হয়। সুফি সাধকদের মতে, দরুদ এমন এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন যা অন্তরকে কোমল করে, চরিত্রকে সুশীলতায় পরিপূর্ণ করে এবং সত্য অনুসন্ধানের পথে প্রেরণা জোগায়।

ইতিহাসে বুজুর্গদের জীবনে দেখা যায়, কঠিন পরিস্থিতি, মানসিক চাপ, ভয় ও বিপদের মুহূর্তে দরুদ তাদের জন্য রহমত ও প্রশান্তির দরজা খুলে দিয়েছে। দরুদ দোয়ার কবুল হওয়া সহজ করে—এটি শুধু তত্ত্ব নয়; অসংখ্য হাদিসে এর নির্দেশ রয়েছে। এক বর্ণনায় এসেছে- ‘বেশি বেশি দরুদ পাঠ করলে জীবনের মাকসুদ হাসিল হয়।’ (তিরমিজি, মাজমাউজ জাওয়ায়েদ)
এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দরুদ মানুষের জীবনে কল্যাণ, বরকত ও আলোকময়তা নিয়ে আসে, যা তার দৈনন্দিন কাজকর্মেও ইতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হয়।

আরও পড়ুন: সকাল- বিকেল ১০ বার দরুদ পড়লে যা পাবেন

ইতিহাস ও বুজুর্গদের অভিজ্ঞতায় দরুদের শক্তি

মুসলিম ইতিহাসের বড় বড় আলেম ও বুজুর্গ দরুদকে রূহানি উন্নতির অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর ‘ইহইয়া উলুমুদ্দীন’-এ দরুদের আধ্যাত্মিক সুফলকে হৃদয় পরিশুদ্ধির কার্যকর পথ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। ইমাম নববি (রহ.) তাঁর ‘আল-আজকার’ গ্রন্থে সহিহ দলিলসহ দরুদ পাঠের বিধান, ফজিলত ও আদব বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। উপমহাদেশের আউলিয়া-সাধকেরা বিভিন্ন দরুদকে রূহানি চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার করেছেন, যা মানুষের অন্তরকে উদ্বুদ্ধ ও প্রশান্ত করতে সহায়তা করত।

এই ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে- দরুদ শরিফ শুধু আমলের তালিকার একটি অংশ নয়; বরং আধ্যাত্মিক জগতে এটি প্রভাবক শক্তির মতো কাজ করে, যা কল্যাণকে আকর্ষণ করে এবং বিপদ-আপদ দূরীকরণে সহায়ক হয়।

সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি ও সতর্কতা

যেকোনো ইবাদতের মতো দরুদের ক্ষেত্রেও প্রামাণিক দলিল অনুসরণ জরুরি। দরুদের ফজিলত সম্পর্কে প্রচলিত অনেক জাল ও দুর্বল হাদিস রয়েছে, যেগুলো পরিহার করা উচিত। সহিহ হাদিসে প্রমাণিত দরুদসমূহ, বিশেষ করে দরুদে ইবরাহিমি সুন্নাহসম্মত ও সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য।

দরুদ কোনো ফরজ ইবাদতের বিকল্প নয়; বরং এটি ঈমান, সালাত, জিকির ও দোয়ার শক্তিকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। এর প্রকৃত প্রভাব আসে নিয়মিত পাঠ, একাগ্রতা, বিনয় এবং নবীজির প্রতি আন্তরিক ভালোবাসার মাধ্যমে। নিয়মিতভাবে শ্রদ্ধাভরে দরুদ পাঠ করাই মুমিন জীবনের আধ্যাত্মিক উজ্জ্বলতা ও সফলতার অন্যতম পথ।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর