মানুষ সামাজিক জীব; পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সমাজ সবক্ষেত্রেই কথাবার্তা যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু কথোপকথনের এক বড় বিপদ হলো অনুমান, অধিক ব্যাখ্যা বা প্রসঙ্গ না বুঝে মন্তব্য করা। ইসলামে এই আচরণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কারণ অনুমানভিত্তিক কথা সত্য বিকৃত করে, বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং সম্পর্কের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে।
কোরআনের বিধান: জ্ঞানহীন বিষয়ে মন্তব্য নিষিদ্ধ
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وَلَا تَقْفُ مَا لَیْسَ لَكَ بِهٖ عِلْمٌ اِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ اُولٰٓىِٕكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـُٔوْلًا ‘যে বিষয়ে তোমার নিশ্চিত জ্ঞান নেই, তার পেছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তর প্রত্যেকের নিকট কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ৩৬)
এই আয়াতে শুধু কথা বলা নয়; শোনা, দেখা এবং মনে ধারণা তৈরি করায়ও জবাবদিহিতার কথা বলা হয়েছে। ইসলামের মূলনীতি হলো- নিশ্চিত জ্ঞান ছাড়া কথা বলা, সিদ্ধান্ত দেয়া বা বিচার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
অনুমান ও অপবাদ: একই শিকলের দুটি সংযোগ
অনুমান প্রায়ই মিথ্যা অপবাদের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা সুরা নাহলে ইরশাদ করেন- وَلَا تَقُوْلُوْا لِمَا تَصِفُ اَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هٰذَا حَلٰلٌ وَّهٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوْا عَلَی اللهِ الْكَذِبَ ‘আর তোমাদের জিহবা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য।’ (সুরা নাহল: ১১৬)
বিজ্ঞাপন
জানাশোনা ছাড়া কোনো বিষয়কে হালাল-হারাম বলা বা কারো চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করাও মিথ্যা অপবাদ।
আরও পড়ুন: প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষারোপ করার শাস্তি
সমাজবিধ্বংসী রোগ: অনুমান, গোয়েন্দাগিরি ও গিবত
সুরা হুজরাতে আল্লাহ তাআলা তিনটি সমাজবিধ্বংসী আচরণকে একসাথে নিষিদ্ধ করেছেন- يٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اجْتَنِبُوْا كَثِیْرًا مِّنَ الظَّنِّ ؗ اِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ اِثْمٌ وَّلَا تَجَسَّسُوْا وَلَا یَغْتَبْ بَّعْضُكُمْ بَعْضًا ‘হে ঈমানদারগণ! অধিকাংশ অনুমান থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কিছু অনুমান পাপ। গোয়েন্দাগিরি করো না এবং একে অপরের গিবত করো না।’ (সুরা হুজরাত: ১২)
এখানে স্পষ্ট যে, অনুমান, গোয়েন্দাগিরি, গীবত—এই তিনটি ধাপে সমাজের ভিত্তি ধ্বংস হয়।
হাদিসের কঠোর সতর্কতা: ‘অনুমানই সবচেয়ে বড় মিথ্যা’
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- إِيَّاكُمْ وَالظَّنَّ؛ فَإِنَّ الظَّنَّ أَكْذَبُ الْحَدِيثِ ‘তোমরা অনুমান থেকে বেঁচে থাক। কারণ অনুমানই সবচেয়ে বড় মিথ্যা।’ (সহিহ বুখারি: ৬০৬৬; মুসলিম: ২৫৬৩)
আরেক হাদিসে তিনি সতর্ক করেছেন- كَفَى بِالْمَرْءِ كَذِبًا أَنْ يُحَدِّثَ بِكُلِّ مَا سَمِعَ ‘যে ব্যক্তি শোনা কথা বলে বেড়ায়, তার জন্য এতটুকুই মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (সহিহ মুসলিম: ৫)
আরও পড়ুন: অন্যের দোষ গোপন করার পুরস্কার
সমাধানের ইসলামি পদ্ধতি
১. যাচাই-বাছাই: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা যাচাই করবে...।’ (সুরা হুজরাত: ৬)
২. নীরবতা: রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি-মুসলিম)
৩. সরাসরি জিজ্ঞাসা: সন্দেহ হলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে জানার চেষ্টা করা সুন্নাহ।
৪. ভালো ধারণা: অন্য মুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা ঈমানের দাবি।
আধুনিক প্রেক্ষাপট: সোশ্যাল মিডিয়া ও গুজব
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যাচাই ছাড়া তথ্য শেয়ার করা, অর্ধেক খবর প্রচার করা এবং কারো পোস্ট বা ছবি দেখে তার চরিত্র, ঈমান বা নিয়ত নিয়ে অনুমান করা—এসবই ইসলামি দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ও গুনাহের কাজ। প্রতিটি শেয়ার বোতাম টেপার আগে ‘যাচাই করেছি তো?—এই প্রশ্ন নিজেকে জিজ্ঞাসা করা ঈমানি দায়িত্ব।
ইসলামে অনুমান করে কথা বলা সামাজিক অনাচার, ধর্মীয় পাপ ও ঈমানি দুর্বলতার লক্ষণ। কোরআন ও সুন্নাহ আমাদের শেখায়- সত্য যাচাই করা, অপ্রয়োজনীয় কথা এড়ানো, নীরবতার মর্যাদা রক্ষা করা এবং সর্বদা অন্য মুসলিমের ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা। এই নীতিগুলো অনুসরণ করেই আমরা একটি সুস্থ, বিশ্বাসভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

