শুক্রবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

কঠিন সংকটে নবীজি কেন নামাজে দাঁড়াতেন

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৩৯ পিএম

শেয়ার করুন:

কঠিন সংকটে নবীজি কেন নামাজে দাঁড়াতেন

জীবন অনিশ্চয়তা, পরীক্ষা ও নানান প্রতিকূলতায় ভরা। মানুষ যখন সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন তার হৃদয় অস্থির হয়ে ওঠে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে যায়। এমন সময়ে ইসলামের দৃষ্টিতে সবচেয়ে শক্তিশালী অবলম্বন হলো আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া। প্রিয়নবী (স.) কঠিন পরিস্থিতিতে বিশেষ এক আমল দ্বারা আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা হলো দু’রাকাত নামাজ আদায়। সংকটময় মুহূর্তে নামাজই ছিল নবীজির প্রথম অবলম্বন।

হাদিসের দলিল ও ব্যাখ্যা

হাদিসে এসেছে- كَانَ النَّبِيُّ ﷺ إِذَا حَزَبَهُ أَمْرٌ صَلَّى ‘নবী (স.) যখন কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন, তখন তিনি নামাজ আদায় করতেন।’ (সুনান আবু দাউদ: ১৩১৯)
এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু গভীর অর্থবহ হাদিসটি বোঝায় যে দুঃসময়ে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার সর্বোত্তম উপায় হলো নামাজ।

‘হুজুব’ এর শাব্দিক ও পরিপ্রেক্ষিতগত তাৎপর্য

হাদিসে ব্যবহৃত হুজুব শব্দটি এমন সব পরিস্থিতিকে বোঝায় যা হৃদয়কে সংকুচিত করে, মনকে ভারাক্রান্ত করে এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। এটি কেবল ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট নয়; রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও নেতৃত্বগত জটিল সিদ্ধান্তের মুহূর্তও এর অন্তর্ভুক্ত। নবীজির জীবনে এর প্রয়োগ আমরা দেখি তায়েফ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফেরার পথে, খন্দক যুদ্ধের সময় প্রায় অসম্ভব রণকৌশলের মুখোমুখি হয়ে এবং বদরের মাঠে সংখ্যায় অনেকগুণ শক্তিশালী শত্রুর সম্মুখীন হয়ে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর প্রথম ও স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়া ছিল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন।

আরও পড়ুন: কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া


বিজ্ঞাপন


নামাজ কেন কঠিন সময়ের সমাধান?

প্রথমত, নামাজ হৃদয়ের প্রশান্তি ও ভরসা বৃদ্ধি করে। আল্লাহ তাআলা বলেন- وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلَاةِ ۚ وَإِنَّهَا لَكَبَيِْرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخَاشِعِينَ ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই এটা বিনয়ী ছাড়া অন্যদের জন্য কঠিন।’ (সুরা বাকারা: ৪৫) নামাজের মাধ্যমে বান্দা সরাসরি তার মহান রবের সামনে উপস্থিত হয়, নিজের অসহায়ত্ব ও আল্লাহর অসীম ক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়। এই উপলব্ধিই অন্তরের ভার হালকা করে।

দ্বিতীয়ত, নামাজ সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার শক্তি ও দিকনির্দেশনা দেয়। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) ‘জাদুল মাআদ’-এ উল্লেখ করেন, নামাজ এমন এক আধ্যাত্মিক মিরাজ যার মাধ্যমে বান্দার চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিশুদ্ধ হয়, ফলে সে সমস্যাকে নতুন আলোতে দেখতে পায় এবং হেকমতপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। নবীজির এই আমলের পেছনে একটি গূঢ় দর্শন হলো- সমস্যার সমাধান নয়, বরং সমাধানের উৎস (আল্লাহ) এর সাথে পুনঃসংযোগই প্রকৃত লক্ষ্য।

তৃতীয়ত, নামাজ পাপমুক্তি ও রহমত লাভের মাধ্যম। রাসুল (স.) বলেছেন: أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَهُوَ سَاجِدٌ ‘বান্দা তার রবের সবচেয়ে নিকটবর্তী হয় সেজদা অবস্থায়।’ (সহিহ মুসলিম) فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ ‘তখন তোমরা বেশি বেশি দোয়া করো’ (সহিহ মুসলিম) অর্থাৎ এই নৈকট্যের মুহূর্তে করা দোয়া অধিক মাত্রায় কবুল হয়। তাই কঠিন সময়ে নামাজের সেজদাকেই বিশেষ গুরুত্ব দিতেন নবীজি।

আরও পড়ুন: সকল দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে ৭ বার যে দোয়া পড়তে বলেছেন নবীজি

সীরাতের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

তায়েফবাসীর নির্মম প্রত্যাখ্যান ও শারীরিক আঘাতের পর নবীজি (স.) যে দোয়া করেছিলেন, তা ছিল নামাজ ও সেজদার মধ্যেই নিবেদিত এক মর্মস্পর্শী প্রার্থনা। তিনি বলেছিলেন- ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আমার দুর্বলতা, অক্ষমতা ও মানুষের কাছে আমার হীনতার অভিযোগ করছি... যদি তুমি আমার উপর রাগ না করে থাকো, তবে আমি কোনো পরোয়া করি না...’ (সিরাত ইবনে হিশাম)। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা মেলে যে, নামাজ হলো আল্লাহর কাছে নিজের সমস্ত কষ্ট, অভিযোগ ও প্রত্যাশা নির্যাস করে প্রকাশের সর্বোত্তম মাধ্যম।

একইভাবে, বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি সারা রাত নামাজ ও দোয়ায় মশগুল ছিলেন এবং বলেছিলেন-  ‘হে আল্লাহ!...যদি এই ক্ষুদ্র দলটি ধ্বংস হয়ে যায়, তবে আজকের দিনের পর থেকে জমিনে আর কখনো তোমার ইবাদত করা হবে না।’ (ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৪৪৮০)

আজকের মুসলিমের জন্য প্রাসঙ্গিকতা

আজকের জীবনেও যখনই কোনো গুরুতর সমস্যা আসে, যেমন চাকরি হারানো, রোগ-শোক, পারিবারিক অশান্তি, অর্থনৈতিক সংকট বা নৈতিক দুর্বিপাক, নবীজির এই সুন্নাহ আমাদের পথ দেখায়। প্রথম কাজ হবে দু’রাকাত নামাজে দাঁড়ানো, যেখানে দীর্ঘ কেরাত, রুকু ও সেজদার মাধ্যমে আল্লাহর সামনে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করা। তারপর দোয়া করা-اللَّهمَّ لا سَهْلَ إلَّا ما جعَلْتَه سَهلًا وأنتَ تجعَلُ الحَزْنَ سَهلًا إذا شِئْتَ উচ্চারণ: ‘আল্লাহহুম্মা লা সাহলা ইল্লা মা জাআলতাহু সাহলা ওয়া আনতা তাজআলুল হাজানা সাহলা।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ আপনি যা সহজ করেন, তা ছাড়া কিছুই সহজ নয়। আপনি চাইলে কঠিন বিপদকেও সহজ করতে পারেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান)

কঠিন পরিস্থিতিতে নামাজ আদায় নবীজির একটি স্বভাবজাত ও নিয়মিত আমল ছিল। এটি কোনো জাদুকরী রীতি নয়; বরং ঈমানের একটি জীবন্ত প্রকাশ, যেখানে বান্দা স্পষ্টভাবে স্বীকার করে নেয় যে সমস্ত সমাধানের মালিক একমাত্র আল্লাহ, আর নামাজ হলো সেই মালিকের দরবারে হাজিরা দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি। 

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর