ইউরোপের ইতিহাসে ইসলাম এখন একটি স্থায়ী ও দ্রুত বর্ধমান অধ্যায়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৬ সালের তথ্যমতে, ইউরোপের ৩০টি দেশে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২.৫৭ কোটি, যা মোট জনসংখ্যার ৪.৯%। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে এই হার বেড়ে সর্বোচ্চ ১৪% পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
তবে সংখ্যার আড়ালে ঘটছে আরও গভীর এক পরিবর্তন। ইউরোপে জন্ম নেওয়া মুসলিম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নতুন ইসলামি জাগরণ, ধর্মীয় চেতনার পুনরুত্থান ও ইসলামি পরিচয়ে গর্ববোধের প্রবণতা।
বিজ্ঞাপন
ইতিহাস ও বর্তমান চিত্র
ইউরোপে ইসলামের ইতিহাস অষ্টম শতাব্দীতে স্পেনে উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের (‘মুর’দের) আগমন থেকে শুরু। উসমানীয় সাম্রাজ্যের মাধ্যমে বলকান অঞ্চলেও ইসলাম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ শতকের শেষভাগ ও একবিংশ শতকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে মুসলিম অভিবাসনের ধারা ইউরোপের ধর্মীয় চেহারা বদলে দেয়।
বর্তমানে ইউরোপীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের তুলনামূলকভাবে তরুণ বয়স কাঠামো ও উচ্চ জন্মহার জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
বিজ্ঞাপন
ইসলামিক অবকাঠামোর বিকাশ
মুসলিম সম্প্রদায়ের বৃদ্ধির সঙ্গে সমান্তরালভাবে গড়ে উঠেছে ইসলামিক অবকাঠামো- মসজিদ, ইসলামিক কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া, দাওয়াহ কার্যক্রম ও ইসলামি আলোচনা চক্রে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।

বৈষম্য ও ইসলামফোবিয়া: কঠিন বাস্তবতা
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মুসলিমরা ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। বিশেষ করে বোরকা-নেকাব বা ইসলামি পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা চরম বৈষম্যের প্রতিফলন।
বিপরীত প্রতিক্রিয়া: বৈষম্যই শাণিত করছে বিশ্বাস
মজার বিষয় হলো, এই বৈষম্য অনেক তরুণ মুসলিমকে ধর্ম থেকে দূরে সরায়নি; বরং তাদের ধর্মীয় চেতনা ও পরিচয়কে আরও দৃঢ় করেছে। ইসলাম তাদের জন্য আত্মসম্মান, নৈতিক ভিত্তি ও বৈশ্বিক উম্মাহর সঙ্গে সংযোগের সেতুতে পরিণত হয়েছে।
আরও পড়ুন: ইসলামের স্বর্ণযুগ কখন ছিল, আবার আসবে কি?
ডিজিটাল দাওয়াহ: সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন জাগরণ
ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও পডকাস্টের মাধ্যমে তরুণ মুসলিমরা ইসলামি স্কলারদের বিশ্লেষণ শুনছেন এবং নিজেরাও কনটেন্ট তৈরি করছেন। এভাবে একটি শক্তিশালী ‘ভার্চুয়াল উম্মাহ’ গড়ে উঠছে।
ক্যাম্পাস ও সমাজে সক্রিয় ইসলাম
ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে কোরআন অধ্যয়নচক্র, ইসলামিক আলোচনা ও দাওয়াহ কর্মশালা নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে। নামাজ, রোজা ও হালাল জীবনাচারের প্রতি তরুণদের আগ্রহ দ্রুত বাড়ছে।

ভবিষ্যতের ইউরোপ: বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত
পিউ রিসার্চ সেন্টারের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৫০ সালে ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যার হার হতে পারে:
- শূন্য অভিবাসন হলে: ৭.৪%
- মধ্যম হারে অভিবাসন হলে: ১১.২%
- উচ্চ হারে অভিবাসন হলে: ১৪%+
এই পরিবর্তন শুধু জনসংখ্যাগত নয়; ইউরোপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করবে।
আরও পড়ুন: ইমামতিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দিল ফ্রান্স
সংখ্যা নয়, বিশ্বাসের দৃঢ়তাই মূল কথা
ইউরোপে মুসলিম তরুণদের ইসলামপ্রীতির এই উত্থান কেবল জনসংখ্যা বৃদ্ধির গল্প নয়; এটি একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের ইতিহাস। বৈষম্য, ইসলামফোবিয়া ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও তারা প্রমাণ করেছে- বিশ্বাস দমিয়ে রাখা যায় না। প্রতিকূলতা তাদের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল করে তুলছে।
এই তরুণ প্রজন্মের হাতে ইসলাম ইউরোপে নতুন রূপে বিকশিত হবে, ইনশাআল্লাহ।
তথ্যসূত্র:
পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০১৬
জনসংখ্যা গবেষণা: ওয়েস্টফ ও ফ্রেজকা, ২০০৭
ইউরোপে মিডিয়া ও ইসলামফোবিয়া গবেষণা: রমজান, উইদিয়ানিংসিহ, জুলফা ও হায়াতুল্লাহ (২০২৫)

