ইসলাম বিশ্ব ইতিহাসে একটি অমর জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হিসেবে পরিচিত। এর ইতিহাসে কিছু সময়কে স্বর্ণযুগ বলা হয়, যেখানে মুসলিম উম্মাহ ধর্ম, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও ন্যায়বিচারে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। মহানবী (স.)-এর হাদিস এবং ঐতিহাসিক দলিলসমূহে এ স্বর্ণযুগ ক্ষণজন্মা নয়—বরং অদূর ভবিষ্যতে আবার এমন একটি যুগ ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই প্রতিবেদনে ইসলামের ঐতিহাসিক স্বর্ণযুগের সময়কাল ও বৈশিষ্ট্য এবং হাদিসের আলোকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য স্বর্ণযুগ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা হলো।
ইসলামের প্রাথমিক স্বর্ণযুগ (৭ম-১৩শ শতাব্দী)
১. খোলাফায়ে রাশেদার যুগ (৬৩২–৬৬১ খ্রিস্টাব্দ)
চার খলিফা—আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), উসমান (রা.) ও আলী (রা.)-এর শাসনামলে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ঐতিহাসিক দিক থেকে এটিকে ইসলামের আদর্শিক স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে খিলাফত থাকবে নবুয়তের পথের ওপর… অতঃপর আল্লাহ যখন ইচ্ছা তা তুলে নেবেন। তারপর রাজতন্ত্র আসবে... এরপর আবার নবুয়তের পথে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে।’ (মুসনাদে আহমদ; মেশকাত: ৫৩৭৮)
এখানে ভবিষ্যতে আবার নবুয়তের পথে একটি খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা স্পষ্ট।
বিজ্ঞাপন
২. উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগ (৬৬১–১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ)
উমাইয়া খিলাফত: ইসলাম ইউরোপ (স্পেন), উত্তর আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় বিস্তৃত হয়।
আব্বাসীয় খিলাফত: বিশেষত হরুন অর রশিদ ও আল-মামুনের আমলে “বায়তুল হিকমা” প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসক ও গণিতজ্ঞরা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন।
ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন লিখেছেন, ‘আব্বাসীয় খিলাফত ইসলামের স্বর্ণযুগের শিখর, যেখানে বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা বিকশিত হয়।’ (রোম সাম্রাজ্যের পতন ও অবনতি ইতিহাস, খণ্ড ৬, অধ্যায় ৫৪, পেঙ্গুইন ক্লাসিক্স সংস্করণ)
এই সময়ে মুসলিমরা গ্রিক, ফারসি ও ভারতীয় জ্ঞান অনুবাদ করে বিশ্বজ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
আরও পড়ুন: বদরযুদ্ধে অংশ নেওয়া সাহাবিদের অনন্য মর্যাদা
ইসলামের স্বর্ণযুগ পতনের কারণ
ইসলামের স্বর্ণযুগের অবসান বেশ কয়েকটি জটিল কারণের ফল। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল রাজনৈতিক অভ্যুত্থান ও ভাঙন, যেমন উমাইয়া থেকে আব্বাসীয় খিলাফতের অবসান ও পরে খিলাফতের পতন। খিলাফতের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে যাওয়া, স্থানীয় শাসকদের স্বাধীনতা বৃদ্ধি, এবং অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ ও দাঙ্গা-বিদ্রোহ স্বর্ণযুগের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে।
তাছাড়া, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব ও সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে প্রশাসনিক দুর্বলতা বেড়ে যায়। গ্রিক ও অন্যান্য প্রাচীন জ্ঞানের অনুসন্ধান ও অনুবাদ কার্যক্রম স্তব্ধ হয়ে যায়, যার ফলে জ্ঞানচর্চায় ধীরগতির সৃষ্টি হয়। এর পাশাপাশি বাইরের আক্রমণ—যেমন মঙ্গোলের আক্রমণ (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ ধ্বংস) ও স্বর্ণযুগের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সকল কারণ একত্রিত হয়ে ইসলামের ঐতিহাসিক স্বর্ণযুগের অবসান ঘটায়।
আরও পড়ুন: ওমর (রা.) যেসব কারণে ইতিহাসে অনন্য
ভবিষ্যতের স্বর্ণযুগ: হাদিসের আলোকে
মাহদি (আ.)-এর আগমন
রাসুলুল্লাহ (স.) অনেক হাদিসে ইমাম মাহদির আগমনের কথা বলেছেন, যিনি পৃথিবীতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ইসলামকে আবার সেরা অবস্থানে নিয়ে আসবেন। নবীজি বলেন, ‘মাহদি হবে আমার বংশধর... তিনি পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে ভরে দেবেন যেভাবে তা অন্যায়-অবিচারে ভরা থাকবে।’ (সুনান আবু দাউদ: ৪২৮৪)
ঈসা (আ.)-এর অবতরণ
মাহদির সময় ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন, দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবেন এবং পৃথিবীতে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবেন। নবীজি বলেন, ‘অবশ্যই মরিয়মের পুত্র (ঈসা) তোমাদের মাঝে ন্যায়বিচারী শাসক হয়ে অবতরণ করবেন...’( সহিহ বুখারি: ২২২২)
মোটকথা, ইসলামের অতীতের স্বর্ণযুগ ছিল নেতৃত্ব, জ্ঞান, ন্যায়বিচার এবং আধ্যাত্মিক উৎকর্ষতার যুগ। নবীজির হাদিস এবং ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ভবিষ্যতে আবারও এমন একটি স্বর্ণযুগ আসবে, যখন মহাপরিশুদ্ধ নেতৃত্বের অধীনে মুসলিম উম্মাহ বিশ্বে পুনরায় শোভিত হবে। তাই মুসলিমদের উচিত আত্মিক ও জ্ঞানগতভাবে প্রস্তুত থাকা।

