ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য ব্যক্তিত্বের জীবনী পড়েছেন কি? যাঁর লজ্জাশীলতা এতই প্রবল ছিল যে স্বয়ং ফেরেশতাকুলও তাঁর সামনে লজ্জা পেতেন। রাসুলুল্লাহ (স.) যাঁকে নিয়ে বলেছিলেন- أَلَا أَسْتَحِي مِنْ رَجُلٍ تَسْتَحِي مِنْهُ الْمَلَائِكَةُ ‘আমি কি এমন ব্যক্তিকে লজ্জা করব না, যাঁকে ফেরেশতারাও লজ্জা করেন?’ (সহিহ মুসলিম: ৬১০৩)
১. ফেরেশতাদেরও যাঁর সামনে লজ্জা হতো
একদিনের ঘটনা। রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁর গৃহে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তখন তাঁর উরু কিংবা পায়ের নলা উন্মুক্ত ছিল। এমন সময় প্রথমে হজরত আবু বকর (রা.), এরপর হজরত ওমর (রা.) প্রবেশ করলেন। রাসুল (স.) স্বাভাবিক অবস্থাতেই তাঁদের সাথে কথা বললেন। কিন্তু যখন পরবর্তীতে হজরত উসমান (রা.) আসার অনুমতি চাইলেন, তখন রাসুল (স.) সঙ্গেসঙ্গে উঠে বসে নিজের পোশাক গুছিয়ে নিলেন।
উসমান (রা.) কথা বলে চলে যাওয়ার পর আয়েশা (রা.) বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন, আবু বকর (রা.) এলেন, আপনি তাঁকে কোনো গুরুত্ব দিলেন না ও ভ্রুক্ষেপ করলেন না, ওমর (রা.) এলেন আপনি তাঁকেও গুরুত্ব দিলেন না ও ভ্রূক্ষেপ করলেন না। উসমান (রা.) প্রবেশ করতেই আপনি উঠে বসলেন এবং জামা ঠিক করে নিলেন। রাসুলুল্লাহ (স.) উত্তর দিলেন, ‘আমি কি এমন ব্যক্তিকে লজ্জা করব না, যাঁকে ফেরেশতারাও লজ্জা করেন? (সহিহ মুসলিম: ৬১০১)
শিক্ষণীয় বিষয়: এই ঘটনা প্রমাণ করে, লজ্জাশীলতা যখন কারো চরিত্রে পূর্ণরূপে বিরাজ করে, তখন তা মানবিক সীমা অতিক্রম করে ফেরেশতাদের কাছেও সম্মান অর্জন করে।
আরও পড়ুন: যে সাহাবির সঙ্গে কথা বলেছেন মহান আল্লাহ
বিজ্ঞাপন
২. নির্জনেও লজ্জা পেতেন
এই মহান সাহাবির লজ্জাশীলতা কেবল মানুষের সামনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তেও আল্লাহর প্রতি এই লজ্জাবোধ অটুট থাকত। তিনি নিজেই বলতেন, ‘আমি যখন একান্তে (বাথরুমে) যাই, তখন আমার নিজের জন্যেও এমনভাবে (শরীর) আবৃত রাখি যে, (আল্লাহর কাছে) আমার নিজের কাছেও আমি লজ্জাবোধ করি।’ (এই উক্তিটি বিভিন্ন সিরাতগ্রন্থে বর্ণিত আছে) এজন্য জুমার দ্বিতীয় খুতবায় বলা হয় ‘ওয়া হায়া আন উসমান’ (‘উসমান রা.-এর লজ্জাশীলতার মতো লজ্জাশীলতা দান করুন’। এটি জুমার খুতবায় সাহাবিদের গুণাবলী স্মরণ করে দোয়া আকারে বলা হয়।)
শিক্ষণীয় বিষয়: সত্যিকার লজ্জাশীলতা হলো সর্বদা আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করা। মানুষের দৃষ্টির আড়ালেও যিনি আল্লাহর সামনে লজ্জা বোধ করেন, তিনিই প্রকৃত মুমিন।
৩. রাসুলুল্লাহ (স.)-এর বিশেষ প্রশংসা
হজরত উসমান (রা.)-এর লজ্জাশীলতা এতই বিশিষ্ট ছিল যে রাসুলুল্লাহ (স.) সরাসরি তাঁর প্রশংসা করে বলতেন- ‘তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাজুক ব্যক্তি হলেন উসমান।’ (তিরমিজি: ৩৭৯০; মেশকাত: ৬১১১)
এই গভীর আত্ম-সচেতনতা এবং আল্লাহর প্রতি নিরন্তর লজ্জাবোধই তাঁকে ‘জুন্নুরাইন’ (দুই নূরের অধিকারী) এবং প্রথম সারির সাহাবির মর্যাদা এনে দিয়েছে। উল্লেখ্য, জুন্নুরাইন বা দুই জ্যোতির অধিকারী বলতে বোঝানো হয়, তিনি নবীজির দুই কন্যাকে (একজনের মৃত্যুর পর আরেকজনকে) বিয়ে করেছিলেন।
আরও পড়ুন: নবীজির ৫টি মহামূল্যবান কথা জানেন না অনেকে
৪. আজকের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা
এই মহান সাহাবির জীবন থেকে আমরা যে মূল্যবান শিক্ষা পাই:
- লজ্জাশীলতা ঈমানের অংশ: রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- الحياء من الإيمان ‘লজ্জা ঈমানের অঙ্গ।’ (সহিহ বুখারি: ২৪)
- আল্লাহর প্রতি সচেতনতা: প্রকৃত লজ্জাশীলতা হলো সর্বদা এই অনুভূতি রাখা যে, আল্লাহ আমাদের দেখছেন।
- সম্মান ও মর্যাদার উৎস: যারা আল্লাহর জন্য লজ্জা বোধ করে, আল্লাহ তাদের মানুষ ও ফেরেশতাদের কাছে সম্মানিত করেন।
হজরত উসমান (রা.) ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র; ইসলামের তৃতীয় খলিফা, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর প্রিয় জামাতা এবং জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ সাহাবির একজন। তাঁর জীবনী আমাদের শেখায় যে, লজ্জাশীলতা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি ঈমানের শক্তি ও আধ্যাত্মিক মর্যাদার প্রতীক।

