ইসলামি জীবনের কেন্দ্রবিন্দু কোরআনুল কারিম। এটি মুসলমানের আচার-আচরণ, ইবাদত ও নৈতিক জীবনের পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। তাই এর তেলাওয়াত সঠিকভাবে শেখা ও শেখানো কেবল সুন্নত নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে ফরজের মর্যাদা রাখে। আলেমদের মতে, নামাজের বৈধতার জন্য কোরআনের ন্যূনতম পরিমাণ এমনভাবে শুদ্ধভাবে পড়া ফরজ, যাতে কোনো হরফ বা উচ্চারণের বিকৃতির কারণে অর্থ পরিবর্তিত না হয়।
কোরআন সঠিকভাবে পাঠ করার গুরুত্ব
কোরআন তেলাওয়াতকে আল্লাহ তাআলা নিজেই একটি ইবাদত হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আর কোরআন ধীরে ধীরে ও স্পষ্টভাবে পাঠ করুন।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ৪) আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনার হৃদয়কে তা দ্বারা সুদৃঢ় করার জন্য আমি আপনার কাছে তা ধীরে ধীরে পরিকল্পিত স্তরে ক্রমশঃ আবৃত্তি করিয়েছি।’ (সুরা ফুরকান: ৩২)
আলেমদের মতে, এখানে ‘তারতিল’ শব্দের অর্থ হলো তাজবিদ ও উচ্চারণের নিয়ম অনুযায়ী কোরআন পাঠ করা। হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘তারতিল মানে হলো হরফগুলোকে সঠিকভাবে উচ্চারণ করা এবং ওয়াকফের নিয়ম জানা।’
আরও পড়ুন: যে সাহাবির তেলাওয়াত শুনতে ফেরেশতারা ভিড় করতেন
নববী যুগে কোরআন শেখার ধারা
কোরআনের প্রতিটি হরফ ও শব্দ যেমন অবতীর্ণ হয়েছে, নবী করিম (স.) সাহাবিদের ঠিক সেভাবেই তা শিক্ষা দিয়েছেন। এটি শুধু তেলাওয়াত নয়, বরং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সংরক্ষিত হয়ে আসা একটি পবিত্র ঐতিহ্য।
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় এটার সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। কাজেই যখন আমরা তা পাঠ করি আপনি সে পাঠের অনুসরণ করুন।’ (সুরা কিয়ামাহ: ১৭-১৯)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন তেলাওয়াত করতে চায় যেমনভাবে তা নাজিল হয়েছে, সে যেন ইবনু উম্মে আবদের মতো পাঠ করে।’ (ইবনু মাজাহ: ১৩৮)
নবীজির শিক্ষাদানের পদ্ধতি
নবী করিম (স.) কোরআন শেখানোর ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান ও ধৈর্যশীল। তিনি শুধু অর্থ বা ব্যাখ্যা নয়, বরং প্রতিটি অক্ষরের সঠিক উচ্চারণ, হরকতের পরিমাণ ও বিরতির নিয়ম পর্যন্ত শেখাতেন।
সাহাবি আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (স.) ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ তেলাওয়াতের সময় প্রতিটি শব্দকে টেনে ও স্পষ্ট করে পড়তেন। (সহিহ বুখারি: ৫০৪৬)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবীজি (স.) আমাকে তাশাহহুদ শেখাতেন ঠিক যেমন কোরআনের সুরা শেখাতেন। (সহিহ বুখারি: ৬২৬৫)
এভাবেই নবী (স.) সাহাবিদের মুখে মুখে কোরআনের সঠিক পাঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আরও পড়ুন: যার কোরআন তেলাওয়াত শুনে কেঁদেছিলেন প্রিয়নবী (স.)
বিশুদ্ধ তেলাওয়াতের মর্যাদা
কোরআন পাঠে দক্ষতা অর্জন একটি বড় মর্যাদার কাজ। রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন পাঠে পারদর্শী, সে উচ্চ মর্যাদার ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট করে পড়ে, তার জন্য দ্বিগুণ সওয়াব রয়েছে।’ (সুনান আবু দাউদ: ১৪৫৪)
তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা সুললিত কণ্ঠে কোরআন পাঠ করো, কারণ তা কোরআনের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।’ (শুআবুল ঈমান: ২১৪১)
কোরআন শেখানোর সামাজিক দায়িত্ব
কোরআন শিক্ষা শুধু ব্যক্তিগত দায়িত্ব নয়, বরং এটি সামষ্টিক দায়িত্বও বটে। যারা শেখে তাদের ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং সঠিক পথে পরিচালিত করা সমাজের দায়িত্ব। যদি ভুলের কারণে অর্থ পরিবর্তিত হয়, তাহলে শুধরে দেওয়া ওয়াজিব। আর যদি না হয়, তবে তা মুস্তাহাব ও উত্তম কাজ।
তবে এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন শিক্ষার্থী নিরুৎসাহিত না হয় বা কোরআন শেখার আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে।
আরও পড়ুন: বিনয়ের সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত শোনার ফজিলত
আল্লাহর সাহায্য কামনা
কোরআন শেখা ও শুদ্ধভাবে পাঠ করার পথে আল্লাহর সাহায্য অপরিহার্য। কোরআনেই সে কথা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে এভাবে- ‘সুতরাং আল্লাহ মহান যিনি সত্যিকার অধিপতি; তোমার প্রতি ওহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আপনি কোরআন পাঠে তাড়াহুড়া করবেন না এবং বলুন- ‘রব্বি জিদনি ইলমান’ (হে আমার রব, আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন)।’ (সুরা ত্বাহা: ১১৪)
কোরআন অবহেলার ভয়াবহতা
কোরআন থেকে দূরে সরে যাওয়া বা এর তেলাওয়াত ত্যাগ করা মারাত্মক গুনাহ। নবীজি (স.) কেয়ামতের দিন অভিযোগ করবেন- ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এই কোরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করেছিল।’ (সুরা ফুরকান: ৩০)
ইবনে কাসির (রহ.) ব্যাখ্যা করেন, কোরআন না শোনা, না বোঝা, মুখস্থ না করা, আদেশ-নিষেধ অমান্য করা কিংবা কবিতা-গানে মগ্ন হয়ে পড়াও কোরআন পরিত্যাগের অন্তর্ভুক্ত।
আরও পড়ুন: কোরআন তেলাওয়াতের সময় কান্না নেককার বান্দাদের অলংকার
কোরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত শুধু একটি ইবাদত নয়, বরং এটি ইসলামি জীবনের মেরুদণ্ড। নবী (স.) যেভাবে সাহাবিদের শেখিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই আমাদেরও শিখতে হবে এবং অন্যকে শেখাতে হবে। সঠিক উচ্চারণ, তাজবিদ, তারতিল এবং আন্তরিকতার মাধ্যমে কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে পারলেই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর রহমত লাভ করতে পারব।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে কোরআনের বিশুদ্ধ তেলাওয়াত শেখার তাওফিক দিন এবং তা হৃদয়ে ধারণ করার শক্তি দিন। আমিন।

