মৃত্যু এক অমোঘ সত্য, আর তার যন্ত্রণা প্রতিটি প্রাণের জন্যই অবধারিত। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন ও হাদিসে এই অনিবার্য যন্ত্রণার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে। এটা হতে তোমরা অব্যাহতি চেয়ে এসেছ।’ (সুরা কাফ: ১৯) এমনকি আমাদের প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (স.)-কেও এই কষ্ট অনুভব করতে হয়েছিল।
মুমিন ও অবিশ্বাসীর মৃত্যু যন্ত্রণার ভিন্নতা
বিশ্বাসীরা যেমন মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করেন, তেমনি অবিশ্বাসীরাও করেন। তবে তাদের যন্ত্রণার ধরণ ও কারণ ভিন্ন।
পাপীদের মৃত্যুযন্ত্রণা: পাপীদের জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা কেবল শারীরিক কষ্ট নয়, বরং তা আজাবের সূচনা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি যদি দেখতে পেতে ফেরেশতারা অবিশ্বাসীদের মুখমণ্ডল ও পিঠে আঘাত করে তাদের প্রাণহরণ করছে এবং বলছে, তোমরা দহনযন্ত্রণা ভোগ করো।’ (সুরা আনফাল: ৫০) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘যদি তুমি দেখতে পেতে যখন অবিচারকারীরা মৃত্যুযন্ত্রণায় থাকবে এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলবে, তোমাদের প্রাণ বের করো। তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে অন্যায় বলতে ও তাঁর নিদর্শন সম্পর্কে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে। সেজন্য আজ তোমাদের অবমাননাকর শাস্তি দেওয়া হবে।’ (সুরা আনআম: ৯৩)
মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা: মুমিনের জন্য মৃত্যুযন্ত্রণা ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। এটি তাদের গুনাহ মাফ বা মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ। রাসুলুল্লাহ (স.) আয়েশা (রা.)-এর এক প্রতিবেশীর মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে তাকে চিন্তিত হতে নিষেধ করে বলেন, ‘তোমার প্রতিবেশীর কারণে তুমি চিন্তিত হয়ো না। কেননা এটা সৎকর্মগুলোর অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ১৪৫১) এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণা তার মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যখন কোনো মুমিনের জন্য কোনো মর্যাদার স্তর নির্ধারণ করেন এবং নিজ আমল দ্বারা যদি তা অর্জন করতে না পারে, তখন আল্লাহ তাঁর শরীর বা তাঁর সম্পদ অথবা তাঁর সন্তানদের বিপদগ্রস্ত করেন। অতঃপর মুমিন ধৈর্যধারণ করার ফলে সে পূর্বনির্ধারিত মর্যাদার স্তরে পৌঁছে যায়।’ (সুনানে আবি দাউদ: ৩০৯০)
বিজ্ঞাপন
শহীদের মৃত্যুযন্ত্রণা সবচেয়ে হালকা
মৃত্যুযন্ত্রণার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেন আল্লাহর পথের শহীদগণ। তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা প্রায় অনুভবযোগ্য নয়। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘তোমাদের কাউকে পিঁপড়া কামড়ালে যতটুকু কষ্ট অনুভব করো, শহীদের নিহত হওয়ার কষ্ট তার চেয়ে বেশি হবে না।’ (সুনানে নাসায়ি: ৩১৬১)
নবীজির মৃত্যুযন্ত্রণা
আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে মুমূর্ষু অবস্থায় দেখেছিলেন। তাঁর সামনে একটি পানিভর্তি বাটি ছিল। তিনি সেই বাটিতে হাত ঢুকিয়ে পানি দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল মলছিলেন এবং বলছিলেন- ‘হে আল্লাহ! মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৯৭৮) এই হাদিস প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর কষ্ট স্বয়ং নবীদেরও তা অনুভব করতে হয়। রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর যন্ত্রণা অনেক কঠিন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৫১০)
নবীজির মৃত্যুযন্ত্রণার ভিন্ন মর্যাদা
আল্লাহ নবীদেরকে দুনিয়াতেই কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করেন, যাতে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। মৃত্যুযন্ত্রণাও ছিল তাঁর সর্বশেষ পরীক্ষা, যা তাঁকে সর্বোচ্চ মাকাম (মর্যাদা) দানের প্রস্তুতি। নবীজি (স.)-এর কষ্ট দেখে সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই, সত্যিই মৃত্যু-যন্ত্রণা কঠিন। তারপর দু’হাত উপরের দিকে উঠিয়ে বলছিলেন, আমি উচ্চে সমাসীন। বন্ধুর সঙ্গে (মিলিত হতে চাই)। এ অবস্থায় তাঁর ইন্তেকাল হলো আর হাত শিথিল হয়ে গেল।’ (বুখারি: ৪৪৪৯) এটি উম্মতকে শিক্ষা দেয়—কষ্টের পরেই রয়েছে চিরস্থায়ী শান্তি।
আরও পড়ুন: নিকৃষ্ট মৃত্যু থেকে রক্ষার বিশেষ আমল
মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হওয়ার দোয়া
মৃত্যুশয্যায় মহানবী (স.) মৃত্যুযন্ত্রণা হালকা হওয়ার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া করেছিলেন-
১. اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى غَمَرَاتِ الْمَوْتِ
উচ্চারণ: '‘আল্লাহুম্মা আঈন্নী আলা গামারা-তিল মাউত।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ, মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুযন্ত্রণা হ্রাসে আমায় সহায়তা করুন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৯৭৮)
২. اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي وَارْحَمْنِي وَأَلْحِقْنِي بِالرَّفِيقِ الأَعْلَى
উচ্চারণ: ‘আল্লা-হুম্মাগফিরলী ওয়ারহামনী ওয়ালহিকনী বিররাফীকিল আ’লা।’
অর্থ: ‘হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার প্রতি দয়া করুন, আর আমাকে মহান বন্ধুর সঙ্গে মিলিত করুন।’ (সহিহ বুখারি: ৫৬৭৪)
পরিশেষে: আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে নেককার মুমিন হিসেবে কবুল করুন এবং মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আমিন।

