আধুনিক মুসলিম সমাজে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো দ্বীনের সাথে আংশিক সম্পৃক্ততা। নামাজ-রোজা পালন করলেও অনেকের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে ইসলামি বিধান উপেক্ষার প্রবণতা দেখা যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হও।’ (সুরা বাকারা ২:২০৮)
ইবনে কাসির (রহ.) এই আয়াতের তাফসিরে ব্যাখ্যা করেন, ‘এ আয়াত মুমিনদেরকে ইসলামের সমস্ত বিধান মেনে চলার নির্দেশ দেয়, কোনো অংশ বাদ দেওয়া যাবে না।’ (তাফসির ইবনে কাসির: ১/৫৬৭)
বিজ্ঞাপন
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: ১. এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (স.) আল্লাহর রাসুল ২. নামাজ কায়েম করা ৩. জাকাত দেওয়া ৪. রমজানের রোজা রাখা ৫. সামর্থ্যবানদের জন্য হজ করা’ (সহিহ বুখারি: ৮, মুসলিম: ১৬)
ইমাম নববি এর ব্যাখ্যা করেন- ‘এ পাঁচটি স্তম্ভ পরিপূর্ণ ঈমানের ভিত্তি। কোনো একটি ছেড়ে দিলে ইসলাম অসম্পূর্ণ থেকে যায়।’ (শারহু মুসলিম: ১/১৪৫)
ইসলামে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার স্তরসমূহ
ইসলামে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার প্রক্রিয়াকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়।
১. ঈমানের স্তর: যা তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রাথমিক স্তর হলো মৌখিক স্বীকৃতি, অর্থাৎ শাহাদাতাইন (কালিমা তাইয়্যিবা) পাঠের মাধ্যমে ইসলামে প্রবেশ করা। তবে এটিই যথেষ্ট নয়, দ্বিতীয় ধাপে হৃদয় দিয়ে এর সত্যতা বিশ্বাস করতে হবে। তৃতীয় ও সর্বোচ্চ স্তর হলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে এর বাস্তবায়ন, অর্থাৎ বিশ্বাস অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করা। এই মত ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ি, ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর। (শারহু ফিকহিল আকবর, মোল্লা আলি ক্বারি, পৃষ্ঠা ১৪১-১৫০)
বিজ্ঞাপন
২. আমলের স্তর: যা তিনটি ভাগে বিন্যস্ত। প্রথমত ফরজ ইবাদতসমূহ যথাযথভাবে আদায় করা, যেমন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, জাকাত প্রদান এবং সামর্থ্যবানদের জন্য হজ পালন। দ্বিতীয়ত সুন্নত অনুসরণের মাধ্যমে নবীজি (স.)-এর জীবনাদর্শকে নিজ জীবনে প্রতিফলিত করা।
আরও পড়ুন: ইসলামে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়ার সুযোগ নেই
৩. হারাম থেকে মুক্ত থাকা: মুমিনকে সব ধরনের হারাম কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে, যা ইসলামি জীবনবিধানের অপরিহার্য দাবি। ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আদেশের অবাধ্যতা করে এবং তাঁর সীমারেখাসমূহ লংঘন করে আল্লাহ তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরস্থায়ী হবে। আর তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা নিসা: ১৪)
এই স্তরগুলো অতিক্রম করার মাধ্যমেই একজন মুসলিম পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হতে পারে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত বিধানের অনুগত হয়।’ (মুসনাদ আহমদ: ১২৩৪৫, সহিহ)
পরিপূর্ণ দাখিল না হওয়ার পরিণতি
ইসলামে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ না করলে ব্যক্তির জীবনে নানাবিধ নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, যা তার আধ্যাত্মিক ও সামাজিক জীবনে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করে। প্রথমত, আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। ঈমানের দুর্বলতা দেখা দেয়, ফলে ব্যক্তির আমলে খেয়ানত বা বিশ্বাসঘাতকতা সৃষ্টি হয়।
দ্বিতীয়ত, সামাজিক জীবনে এর প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী। ব্যক্তির দ্বীনি পরিচয়ে সংকট সৃষ্টি হয়, কেননা সে মুসলিম নামধারী হলেও তার কর্ম ও আচরণে ইসলামের প্রকৃত রূপ প্রতিফলিত হয় না। এ অবস্থা সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং অমুসলিমদের কাছে ইসলামের ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়।
পরকালীন জবাবদিহিতার ভয়াবহতা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘সেদিন তাদের মুখমণ্ডল অগ্নিতে উল্টে পাল্টে দেওয়া হবে, বলা হবে তোমরা যা করতে তার স্বাদ গ্রহণ করো।’ (সুরা আনফাল: ৫০) ইবনে কাসির (রহ.) এ আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, ‘এটি বিশেষভাবে তাদের জন্য যারা ইসলামের দাবিদার হয়েও পরিপূর্ণভাবে দাখিল হয়নি।’ (তাফসির ইবনে কাসির: ৪/৪২১)
আরও পড়ুন: মুসলমান দলে দলে বিভক্ত হওয়া কেমন গুনাহ?
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৮% অপরাধপ্রবণ মুসলিম যুবকই নামাজ ও ইসলামের অন্যান্য মৌলিক বিধান পালনে অবহেলা করে। এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলামে অসম্পূর্ণ দাখিল হওয়া কীভাবে সামাজিক অবক্ষয় ডেকে আনে। ড. ইউসুফ আল-কারজাভি তার ‘আরকানুল ঈমান ফিল্লাহি তাআলা’ গ্রন্থে সতর্ক করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের কিছু অংশ গ্রহণ করে আর কিছু অংশ বর্জন করে, সে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সীমানা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (আরকানুল ঈমান, পৃষ্ঠা ১৪৭)
মুমিনের করণীয়
ইসলামে নিজেকে প্রবেশ করাতে হবে পরিপূর্ণভাবে। এরপর ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা, হারাম থেকে সমাজ রক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখা জরুরি, ইসলামে কোনোকিছুর ঘাটতি নেই। মানুষের প্রয়োজনেই ইসলাম, যা সম্পূর্ণ নির্ভুল, বিশুদ্ধ ও উপযুক্ত। আল্লাহ তাআলা দয়া করেই তা আমাদের দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম।’ (সুরা মায়েদা ৫:৩)
কল্যাণময় জীবনের জন্য ইসলামে পরিপূর্ণ দাখিল হওয়ার বিকল্প নেই। অন্যথায় সমাজ ও উম্মাহর জন্য ক্ষতি ছাড়া কিছুই বয়ে আনবে না। তাই আসুন কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবনকে পূর্ণাঙ্গরূপে সাজাই এবং আল্লাহর সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করি। আল্লাহ তাওফিক দিন। আমিন।

