হিংসা একটি আত্মবিধ্বংসী মানবিক প্রবৃত্তি যা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। কোরআন ও হাদিসে হিংসাকে ‘অদৃশ্য বিষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। নিচে হিংসার ৬টি ধ্বংসাত্মক প্রভাব বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো।
১. নেক আমল নষ্ট হয়
আল্লাহ তাআলা বলেন- أَمْ يَحْسُدُونَ النَّاسَ عَلَىٰ مَا آتَاهُمُ اللَّهُ مِن فَضْلِهِ ‘তারা কি লোকদেরকে হিংসা করে, আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তার কারণে?’ (সুরা নিসা: ৫৪)
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- إياكُم والحَسَدَ، فإنَّ الحَسَدَ يأكُلُ الحَسَناتِ كما تأكُلُ النَارُ الحَطَبَ ‘হিংসা থেকে সাবধান! কেননা হিংসা নেকিকে এমনভাবে ধ্বংস করে; যেমন আগুন লাকড়ি ধ্বংস করে।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৪৯০৩)
প্রভাব: হিংসুক ব্যক্তির ইবাদতে অনীহা জন্মে। নেক কাজের স্বাদ হারিয়ে যায়।
ইসলামি সমাধান: প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা সুরা ফালাক ও নাস পড়ুন। সাথে এই দোয়া পড়ুন- اللَّهُمَّ طَهِّرْ قَلْبِي مِنَ الْحَسَدِ ‘আল্লাহুম্মা তাহির কালবি মিনাল-হাসাদ’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে হিংসা থেকে পরিশুদ্ধ করে দিন।’
আরও পড়ুন: হিংসা-বিদ্বেষ না থাকা জান্নাতিদের গুণ
২. ঈমানের ক্ষতি করে
হিংসা ঈমানকে মারাত্মকরূপে ক্ষতিগ্রস্ত করে। নবীজি (স.) বলেছেন- وَلَا يَجتَمِعُ فِي جَوفِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالحَسَدُ ‘কারো অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্র হতে পারে না।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৪৬০৬)
প্রভাব: হিংসুক আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে যায়। আখেরাতের চিন্তা কমে যায়।
ইসলামি সমাধান: নিয়মিত ইস্তেগফার পড়ুন। দৈনিক ১০০ বার ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ পড়ুন।
৩. রিজিক সংকুচিত হয়
আলেমরা বলেন, হিংসার কারণে রিজিকের বরকত কমে যায়। মূলত হিংসা আল্লাহভীতি (তাকওয়া) নষ্ট করে, ফলে রিজিকের বরকত হ্রাস পায়। তাছাড়া হিংসা তাকদিরের ওপর বিশ্বাসে ঘাটতি সৃষ্টি করে, যা অস্থিরতা ও রিজিকের অসন্তুষ্টি ডেকে আনে।
প্রভাব: হিংসা মানসিক চাপ বাড়ায়, যা স্বাস্থ্য ও আর্থিক ক্ষতির কারণ এবং তানেতিবাচক চিন্তা সৃষ্টিশীলতা ও কর্মোদ্দীপনা নষ্ট করে।
ইসলামি সমাধান: গোপনে সদকা দিন (সুরা বাকারা: ২৭৪)। দোয়া পড়ুন- ‘আল্লাহুম্মা বারিক লী ফী রিজকী’ (হে আল্লাহ! আমার রিজিকে বরকত দান করুন)
৪. আত্মবিশ্বাস ধ্বংস করে
আল্লাহ তাআলা বলেন- وَلَا تَتَمَنَّوْا مَا فَضَّلَ اللَّهُ بِهِ بَعْضَكُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ‘আর তোমরা আকাঙ্ক্ষা করো না সেসবের, যার মাধ্যমে আল্লাহ তোমাদের একজনকে অন্যজনের উপর প্রাধান্য দিয়েছেন।’ (সুরা নিসা: ৩২)
আরও পড়ুন: ইসলামে ‘দৃঢ়তা’ অনেক মূল্যবান গুণ
প্রভাব: হিংসার কারণে ব্যক্তি নিজের সক্ষমতায় সন্দিহান হয়। অন্যের সাফল্য দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আত্মমর্যাদাবোধ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়।
ইসলামি সমাধান: প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় পড়ুন- ‘আল্লাহুম্মাসলিহ লী নাফসী ওয়া জুররিয়্যাতী’ (হে আল্লাহ! আমার নিজের ও সন্তানদের সংশোধন করুন) (সুরা নূহ: ২৮ এর আলোকে)। ১০০ বার পড়ুন- ‘হাসবিয়াল্লাহু ওয়া নি’মাল ওয়াকীল’ (আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি কতইনা উত্তম কার্যনির্বাহী।) (সুরা আলে ইমরান: ১৭৩) আপনার ওপর আল্লাহর নেয়ামতগুলো গোনার চেষ্টা করুন। (সুরা ইবরাহিম: ৩৪ এর আলোকে)
৫. সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে
হাদিসে এসেছে, হিংসা-বিদ্বেষ সম্পর্কচ্ছেদকারী। (সহিহ মুসলিম: ২৫৬৪)
হিংসায় সামাজিক সম্পর্ক নষ্টের অনেক ঐতিহাসিক উদাহরণ রয়েছে। যেমন- হাবিল-কাবিলের ঘটনায় দেখা যায়, হিংসাই প্রথম মানবহত্যার কারণ (সুরা মায়েদা ৫:৩০)। ইউসুফ (আ.)-এ প্রতি ভাইদের হিংসার কারণেই তাঁকে কূপে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। (সুরা ইউসুফ: ৮-১০)
প্রভাব: পারিবারিক কলহ সৃষ্টি করে। সমাজে অস্থিরতা বাড়ে
ইসলামি সমাধান: সালামের প্রচার প্রসার বাড়ান (সহিহ মুসলিম: ৫৪)। এই দোয়া পড়ুন- ‘আল্লাহুম্মা আল্লিফ বাইনা কুলুবিনা’ (হে আল্লাহ! আমাদের হৃদয়সমূহের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপন করুন)
৬. শারীরিক ও মানসিক রোগ সৃষ্টি করে
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘..বলে দাও, তোমাদের আক্রোশেই তোমরা মরো..।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১৯)
প্রভাব: চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, হিংসা উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডিপ্রেশন সৃষ্টি করে। মস্তিষ্কে কর্টিসল হরমোন বৃদ্ধি করে, যা কোষ ধ্বংস করে।
ইসলামি সমাধান: নিয়মিত দোয়া ইউনুস পড়ুন। মেডিকেল চিকিৎসার পাশাপাশি রুকইয়াহ করুন।
হিংসা থেকে বাঁচতে কোরআন ও হাদিসের এই অমূল্য বাণীগুলো অবশ্যই মনে রাখবেন—
قَدْ اَفْلَحَ مَنْ زَكّٰىهَا، وَ قَدْ خَابَ مَنْ دَسّٰىهَا ‘অবশ্যই সে সফল হয়েছে, যে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর সে ব্যর্থ হয়েছে, যে তা বিনষ্ট করেছে।’ (সুরা শামস: ৯-১০)
انْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ أَسْفَلَ مِنْكُمْ، وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ ‘তোমাদের চেয়ে যে উপরের অবস্থানে আছে তার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে যে নিচের অবস্থানে আছে তার প্রতি দৃষ্টি দাও। (জামে তিরমিজি: ২৫১৩)

