হজের মাস শেষ হতে চলেছে। ক’দিন পরই শুরু হবে হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম, যে মাসকে কোরআন ও হাদিসে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এটি আত্মশুদ্ধি, ইবাদত, রোজা, তাওবা এবং ইতিহাসচেতনার এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই বরকতময় মাসে প্রবেশের আগে একজন মুমিনের উচিত কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করা—যা তাকে পাপ থেকে বিরত রেখে সওয়াব অর্জনের দিকে এগিয়ে নেবে।
মহররমের আগে ৮টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি
১. নিয়ত ও অন্তরের পরিশুদ্ধি
মহররম মাসে ইবাদতের ফজিলত অনেক বেশি। তাই এই মাসে প্রবেশের আগে নিয়ত করুন বেশি বেশি রোজা রাখবেন, গুনাহ থেকে ফিরে আসবেন, বিগত বছরের ভুলের জন্য ক্ষমা চাইবেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, সে এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের গুনাহ আল্লাহ ভালো কাজ দ্বারা পরিবর্তন করে দেন।’ (সুরা ফুরকান: ৭০)
২. আশুরা রোজার পরিকল্পনা (৯ ও ১০ মহররম)
নবী (স.) বলেছেন, ‘আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহর কাফফারা হয়ে যায়।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৬২) তিনি আরও বলেন, নবী (স.) বলেন, ‘রোজার জন্য রমজান মাসের পর সর্বোত্তম মাস হল মহররম।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৬৩) অন্য হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা আশুরার দিন (মহররমের দশম দিবস) রোজা রাখো এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ করো। আশুরার আগে এক দিন বা পরে এক দিন রোজা রাখো।’ (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪)
অর্থাৎ ৯ ও ১০ মহররম বা ১০,১১ মহররম রোজা রাখার এখন থেকেই নিয়ত করা উচিত।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: মহররমের প্রথম ১০ দিন রোজা নিয়ে হাদিস আছে কি?
৩. মহররমের ফজিলত ও কারবালার ইতিহাস জানা
আশুরার দিনের মর্যাদা ও ঐতিহ্য ইসলামপূর্ব যুগ থেকে চলে আসছে। এই দিনে মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীরা ফেরাউন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা এই দিন ফেরাউন ও তার সৈন্যদের সাগরে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছিলেন। পরে কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা ঘটেছে এই দিনে।
ইতিহাস না জানলে শিক্ষা গ্রহণ অসম্ভব। এই দিনে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনায় শোক নয়—বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার শিক্ষা নিতে হবে এবং নবী দৌহিত্র্যকে অন্তর থেকে ভালোবাসতে হবে। নবী (স.) একবার হাসান ও হোসাইনের হাত ধরে বলেন, যে ব্যক্তি আমাকে ও এই দুজনকে ভালোবাসল এবং এদের মাতা-পিতাকে ভালোবাসল সে কেয়ামত দিবসে আমার সঙ্গে আমার ঠিকানায় থাকবে। (তিরমিজি: ৩৭৩৩)
৪. তাওবা ও ইস্তেগফারের অভ্যাস গড়ে তোলা
মহররমে ক্ষমা পাওয়ার অনন্য সুযোগ রয়েছে। রাসুল (স.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি ক্ষমা চায়, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন; সে যদি পাহাড়সম গুনাহ করেও থাকে।’ (তিরমিজি: ৩৫৫৯)
৫. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা
কারবালার শিক্ষা—সংঘর্ষ নয়, বরং ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি ও ত্যাগ। এই মাসে আত্মীয়তার সম্পর্ক জোড়া লাগানোর নিয়ত করুন। রাসুল (স.) বলেন, ‘যে আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে, আল্লাহ তার রিজিক বাড়িয়ে দেন ও আয়ু দীর্ঘ করেন।’ (বুখারি: ৫৯৮৬)
আরও পড়ুন: আশুরার ইতিহাসের সঙ্গে যেসব কাহিনি প্রচলিত
৬. দান ও সদকার মানসিকতা তৈরি করা
মহররমে দান করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। আর দান-সদকা হলো পাপ মোচনের অন্যতম উপায়। আল্লাহ বলেন, ‘তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে দান করে। তারা এমন ব্যবসা করে, যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
(সুরা ফাতির: ২৯)
৭. নতুন হিজরি বছরের পরিকল্পনা করা
মুসলিম জীবনে একটি হিজরি বছর মানে আরো বেশি ইবাদতের সুযোগ, তাওবার সুযোগ, কোরআনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)
৮. বিদআতি কার্যকলাপ বর্জনের অঙ্গীকার করা
আশুরা নিয়ে সমাজে অনেক বিদআতের প্রচলন রয়েছে। এখন থেকে নিয়ত করুন এবং শপথ করুন কোনোরকম বিদআত যেন নিজেকে স্পর্শ করতে না পারে। বিশেষত মাতম মর্সিয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। মর্সিয়া মানে নবী দৌহিত্রের শোক প্রকাশে নিজের শরীরে আঘাত করা ও জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা। ইসলামে এটা নিষিদ্ধ। নবী করিম (স.) এ ব্যাপারে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি (শোকে-দুঃখে) চেহারায় চপেটাঘাত করে, জামার বুক ছিঁড়ে ফেলে এবং জাহিলি যুগের মতো হা-হুতাশ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (বুখারি: ১২৯৭)
আরও পড়ুন: আশুরার দিনে যেসব বিদআত নিয়ে সাবধান করেছেন আলেমরা
মনে রাখা জরুরি- ধর্মীয় কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের প্রথা, প্রচলন ও কুসংস্কার বিদআতের অন্তর্ভুক্ত। কিছু কুসংস্কার শিরকের নামান্তর। এগুলো গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পথভ্রষ্ট লোক আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ থাকে।’ (সুরা হিজর: ৫৬) রাসুল (স.) বলেছেন, ‘প্রতিটি বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (মুসলিম: ১৫৩৫)
মহররমের আগে প্রস্তুতি গ্রহণ মানে শুধু আশুরা পালনের প্রস্তুতি নয়; বরং তা একটি আত্মশুদ্ধির যাত্রা শুরু করার সময়। গুনাহ থেকে ফিরে এসে আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ বারবার আসে না। তাই আসুন, আমরা এই বরকতময় সময়কে কাজে লাগাই।

