‘আশুরা’ শব্দটি আরবি। ‘আশারা’ শব্দমূল থেকে নির্গত। অর্থ দশ। শরিয়তের পরিভাষায় মহররমের দশম দিবসকে ‘আশুরা’ বলে অভিহিত করা হয়। এই দিবসকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে নানা ঘটনাপ্রবাহ। এসব ঘটনা-উপাখ্যানের অধিকাংশই মওজু তথা জাল, আর কিছু সহিহ সূত্রে বর্ণিত নয়।
যেমন- আশুরার দিনে কেয়ামত সংঘটিত হবে। নির্ভরযোগ্য কোনো রেওয়ায়েতে এ বিষয়ে কোনো আলোচনাই আসেনি।
বিজ্ঞাপন
এছাড়াও আশুরার দিনে হজরত নূহ (আ.)-এর কিশতি জুদি পাহাড়ে থেমেছিল—সম্পর্কিত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে মুসনাদে আহমদে। এই বর্ণনাটির সনদ খুবই দুর্বল। (দেখুন- মুসনাদে আহমদ: ১৪/৩৩৫, হাদিস: ৮৭১৭, শায়েখ শুয়াইব আরনাউতকৃত হাশিয়াযুক্ত নুসখা)
কোনো রেওয়ায়েতে দেখা যায় যে, আশুরার দিনেই হজরত আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হয়েছে। এ কথাটি মূলত আবুল কাসিম ইস্পাহানী (রহ) কর্তৃক সংকলিত ‘আত-তারগিব ওয়াত তারহিব’-এর ১৮৬৮ নং রেওয়ায়েতে এসেছে। কিন্তু এই রেওয়ায়েতের সনদ খুবই দুর্বল। এছাড়া আরও কিছু রেওয়ায়েতে ঘটনাটি এসেছে, সেগুলো মওজু। ইস্পাহানী (রহ) বর্ণিত ওই রেওয়ায়েতের সনদে দিরার ইবনে আমর নামে একজন রাবি আছেন, যার সম্পর্কে ইমাম ইবনে মায়ীন (রহ) বলেছেন, لا شيء তথা ‘কিছুই না’ ইংরেজিতে ‘নাথিং’। (লিসানুল মিজান: ৪/৩৪০)
অবশ্য কোনো কোনো তাবেয়ি থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা আদম (আ.)-এর তাওবা কবুল হওয়া সম্পর্কে আশুরার দিনের কথা বলতেন। (লাতাইফুল মাআরিফ, ইবনে রজব, পৃষ্ঠা: ১১৩-১১৫; আল-ইলাল ওয়া মারিফাতির রিজাল, আবদুল্লাহ ইবনে ইমাম আহমদ, নম্বর: ৩৭৯৫)
একটি ঘটনায় দেখা যায়, ঈসা (আ.)-এর জন্ম আশুরার দিন হয়েছে। এ কথাটিও প্রমাণিত নয়। আবুল কাসিম ইস্পাহানি (রহ)-এর কিতাব ‘আত-তারগিব ওয়াত তারহিব’-এর পূর্বোক্ত রেওয়ায়েতেই এ কথা এসেছে। আগেই বলা হয়েছে, এর সনদ খুবই দুর্বল। এ ধরণের আরও অনেক কাহিনি সমাজে প্রচলিত রয়েছে। প্রায় সবগুলো ঘটনাই সহিহ সূত্রে প্রমাণিত নয়। ১০ ই মহররম, ৯ মহরম, ১০ই মহররম এর তাৎপর্য
বিজ্ঞাপন
তাহলে কোন ঘটনা আশুরার দিন ঘটেছে বলে প্রমাণিত? এর উত্তর হলো—কেবল দুটি ঘটনাই সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। সেগুলো হলো— ১. হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর সঙ্গীদের ফেরাউন থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘটনা; যেখানে দরিয়ায় রাস্তা বানিয়ে আল্লাহ তাআলা তাঁদেরকে নিরাপদে অপর প্রান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। ২. এই রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করার সময় ফেরাউন ও তার সৈন্যদেরকে দরিয়ায় ডুবিয়ে ধ্বংস করার ঘটনা।
এই দুটি ঘটনা সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিমসহ হাদিসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। মহররম মাসের ইতিহাস, মহররমের আলোচনা
আশুরার দিনটিতে আরেকটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে। সেটি হলো— রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তেকালের প্রায় ৫০ বছর পর ৬১ হিজরির ১০ মহররমে কারবালায় হজরত হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনা। নবী-দৌহিত্রের এ শাহাদাতের করুণ ঘটনাটি মানুষ ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারে না।
তবে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো আমল করা যাবে না। ইসলামি শরিয়তে নবীজির ইন্তেকালের পরের কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন বিধান আবিষ্কার করা বিদআত। যার ঠিকানা জাহান্নাম। আশুরা কি, ১০ মহররমের ফজিলত, দশই মহররমের ফজিলত
পড়ুন: বিদআত কেন প্রত্যাখ্যাত, পরিণাম কী?
আশুরার দিন রোজা রাখা মোস্তাহাব। রাসুলুল্লাহ (স.) যখন মক্কা মুকাররমায় ছিলেন তখনও আশুরার দিন রোজা রাখতেন। এরপর যখন মদিনা মুনাওয়ারায় গেলেন তখন নিজেও রোজা রাখতেন অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন। তাছাড়া রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে এই রোজা ফরজ ছিল। যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো তখন আশুরার রোজা কেবল নফল রোজা হিসেবে নির্ধারিত হলো। তবে সাধারণ নফল রোজার চেয়ে এই রোজার গুরুত্ব বেশি। আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী (স.)-এর কাছে আশুরার রোজা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। নবী (স.) বললেন- أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ ‘আল্লাহর কাছে আমার আশা, তিনি এই রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহিহ মুসলিম: ১১৬২, তিরমিজি: ৭৫২)
নবীজির হাদিস থেকে এই বিষয়টিও জানা যায় যে, আশুরার সঙ্গে মিলিয়ে দুটি রোজা রাখা ভালো। আশুরার সঙ্গে যদি ৯ বা ১১ মহাররমে রোজা রাখা যায় তাহলে আরও ভালো। (মুসনাদে আহমদ: ২১৫৪; সহিহ মুসলিম: ১/৩৫৯)
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের পবিত্র আশুরার দিনটি হলো- ২৯ জুলাই, শনিবার। যারা দুইটি রোজা রাখার নিয়ত করেছেন, তারা ২৮ ও ২৯ জুলাই তথা শুক্রবার ও শনিবার রোজা রাখবেন অথবা ২৯ ও ৩০ জুলাই তথা শনিবার ও রোববারে রোজা রাখবেন।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র আশুরা ও আশুরার রোজা সম্পর্কে সচেতনতা দান করুন। আশুরার দিনের মর্যাদা রক্ষা করার, বিদআত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র: মাসিক আলকাউসার, ১১/০১/১৪৪০ হিজরি আশুরার দিনের ঘটনা, আশুরা কবে ২০২৩, আশুরার ইতিহাস pdf আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য, আশুরা উপলক্ষে আলোচনা, আশুরার গুরুত্ব ও শিক্ষা, আশুরার দশটি ঘটনা, আশুরা সম্পর্কে হাদিস
