পবিত্র কাবা শরিফে অবস্থিত একটি কালো পাথরের নাম হাজরে আসওয়াদ। এই পাথর নিয়ে বহু যুগ ধরে মুসলমানদের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং কৌতূহল কাজ করে। এটি সম্পর্কে একটি প্রচলিত কথা হলো— ‘হাজরে আসওয়াদ মানুষের গুনাহ শুষে নেয়!” কিন্তু ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে এই দাবির ভিত্তি কতটুকু? কোরআন, হাদিস ও ইসলামি পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আমরা বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করব।
হাজরে আসওয়াদের পরিচয় ও অবস্থান
হাজরে আসওয়াদ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে স্থাপিত একটি পাথর। এটি মূলত জান্নাত থেকে আগত (তিরমিজি: ৮৮৭) এবং ইসলামের অন্যতম পবিত্র নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। হজ ও ওমরার সময় মুসলমানরা তাওয়াফের সূচনা ও শেষ এখান থেকেই করেন।
পাপ শুষে নেওয়ার প্রসিদ্ধ হাদিস
হাজরে আসওয়াদকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হাদিসটি হলো- ‘হাজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে এসেছে। এটি ছিল দুধের মতো সাদা, কিন্তু মানুষের পাপ এটিকে কালো করে দিয়েছে।’ (তিরমিজি: ৭৮৭)
এই হাদিস থেকে অনেকে মনে করেন, হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করার ফলে পাপ “শুষে নেয়” এবং এর কারণেই এটি কালো হয়ে গেছে। কিন্তু ইসলামি পণ্ডিতরা এ বিষয়ে কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা নিচে আলোচনা করা হলো।
বিজ্ঞাপন
ইসলামি পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা
ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘এখানে কালো হওয়া বলতে বাস্তবিক অর্থেই রঙ পরিবর্তন বোঝানো হয়েছে। কিছু বর্ণনায় এসেছে, এটি আদম সন্তানের পাপের কারণে কালো হয়েছে, অধিকাংশ আলেম এটি রূপক অর্থে নিয়েছেন।’ (শরহে সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৯)
ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, ‘হাজরে আসওয়াদ মূলত কালো ছিল না; বরং এটি পাপিদের ঘন ঘন স্পর্শে কালো হয়ে গেছে।’ (ফাতহুল বারি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৬৩)
আরও পড়ুন: হাজরে আসওয়াদের ঐতিহাসিক তথ্য
ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘হাজরে আসওয়াদ নিজে উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না। এটি চুম্বন করা হয় রাসুল (স.)-এর অনুসরণে এবং আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে সম্মান দেখাতে।’ (ইগাযাতুল লাহফান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১৫)

ইমাম কুরতুবি বলেন, ‘এটি বলা যায় না যে হাজরে আসওয়াদ পাপ শোষণ করে; বরং এটি ইবাদতের অংশ এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের একটি নিদর্শন।’ (আল-জামি লি আহকামিল কুরআন, তাফসির কুরতুবি, সুরা হজ)
খলিফা হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর একটি বিখ্যাত বক্তব্য আছে যে, হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি তুমি একটি পাথর, তুমি কারও উপকার বা ক্ষতি করতে পারো না। যদি আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম, আমি তোমাকে কখনো চুম্বন করতাম না।’ (সহিহ বুখারি: ১৫৯৭)
হাজরে আসওয়াদ চুম্বনে গুনাহ মাফের মূল ব্যাখ্যা
উল্লেখিত উক্তিগুলো থেকে বোঝা যায়, সাহাবায়ে কেরাম বা সলফে সালেহিনদের কাছে হাজরে আসওয়াদ কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার উৎস ছিল না; বরং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর অনুসরণেই তা সম্মানিত ছিল। আর নবীজির সুন্নতের অনুসরণ সওয়াব লাভ ও গুনাহ মাফের কারণ। সুতরাং মূল ব্যাখ্যা হলো- হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুম্বন যদি ইখলাস ও সুন্নাহ মোতাবেক হয়, তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপ মাফ হতে পারে— তবে এর উৎস আল্লাহ, পাথর নিজে নয়। যদিও মানুষের পাপের কারণেই পাথরটি কালো আকার ধারণ করেছে।

আরও পড়ুন: হাজরে আসওয়াদকে ইশারায় চুম্বনের নিয়ম
হাজেরে আসওয়াদের ফজিলত ও দোয়া কবুলের আশা
হাজরে আসওয়াদ অবশ্যই বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন পাথর। এর চুম্বন বা স্পর্শ করার আমলে রয়েছে বিশেষ ফজিলত। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম কেয়ামতের দিন সাক্ষ্য দেবে তাদের পক্ষে যারা একে ইখলাস সহকারে স্পর্শ করেছে।’ (ইবনে মাজাহ: ২৯৪৪)
এছাড়াও হাদিসে রয়েছে, হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ বা চুম্বন করলে গুনাহ ক্ষমা হতে পারে। তবে এটি আল্লাহর অনুগ্রহের মাধ্যমে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, এই দুটি রোকন (হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে ইয়ামানি) স্পর্শ করা গুনাহগুলোকে মুছে দেয়। (তিরমিজি: ৯৫৯)
অতএব, হাজরে আসওয়াদ মানুষের গুনাহ “শুষে নেয়”—এমন কথা হাদিসে সরাসরি নেই। বরং এটি কালো হয়েছে মানুষের পাপের প্রতিক্রিয়ায়; শুষে নেওয়ার কারেণ নয়। ইসলামি শরিয়তমতে, হাজরে আসওয়াদ ইবাদতের একটি নিদর্শন, আল্লাহর আনুগত্যের স্মারক এবং গুনাহ মাফের মাধ্যম।

