মৃত মা-বাবার আত্মায় সওয়াব পৌঁছানো বড় নেক আমলগুলোর একটি। হাদিসে মৃত মা-বাবার জন্য এমন কিছু আমলের নির্দেশনা রয়েছে, যা জীবিত মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের মতোই সওয়াব। হজরত আবু উসাইদ (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল! বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার কোনো অবকাশ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। চারটি উপায় আছে–১. তাঁদের জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা, ২. তাঁদের কৃত ওয়াদা পূর্ণ করা, ৩. তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা এবং ৪. তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং সুন্দর আচরণ করা। (আল আদাবুল মুফরাদ: ৩৫)
উক্ত হাদিস অনুযায়ী, মৃত মা-বাবার জন্য পরকালীন কল্যাণে বিভিন্ন দোয়া করা, আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ইস্তেগফার করা, জীবিত থাকতে তাদের করা ওয়াদাগুলো পূর্ণ করা, তাঁদের বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ভালো আচরণ করা, তাঁদের আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদি আমলগুলো মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের অন্তর্ভুক্ত। আর তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার অনেক বড় একটি আমল।
বিজ্ঞাপন
মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করো না। তোমরা মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।’ (সুরা নিসা: ৩৬) মহান আল্লাহ আরো বলেন, ‘অতএব তুমি আমার প্রতি ও তোমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। (মনে রেখো, তোমার) প্রত্যাবর্তন আমার কাছেই।’ (সুরা লুকমান: ১৪)
আরও পড়ুন: মায়ের দিকে শুধু তাকালেই কবুল হজের সওয়াব
মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার আল্লাহর পছন্দের আমল এবং তা জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য। আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, রবের সন্তুষ্টি মা-বাবার সন্তুষ্টির মধ্যে এবং তাঁর অসন্তুষ্টি তাঁদের অসন্তুষ্টির মধ্যে। (তিরমিজি: ১৮৯৯) অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মা-বাবাই হলো তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৪২১)
মৃত মা বাবার জন্য নিচের আমলগুলো সুন্নাহভিত্তিক
১. দোয়া করা
মৃত মা-বাবার জন্য দোয়া করা সন্তানের বিশেষ কর্তব্য। কবরে তাদের প্রশান্তির জন্য, মাগফিরাতের জন্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন। যেমন— رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا উচ্চারণ: ‘রাব্বির হামহুমা কামা রব্বায়ানি সগীরা’ অর্থ: “হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’। (সুরা বনি ইসরাইল: ২৪)
মা-বাবার জন্য পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আরেকটি দোয়া হলো— رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ উচ্চারণ: ‘রাব্বানাগ ফিরলী ওয়াল ওয়ালিদাইয়া ওয়ালিল মু’মিনীনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব।’ অর্থ: ‘হে আমাদের রব, রোজ কেয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’। (সুরা ইবরাহিম: ৪১)
২. ওয়াদা বাস্তবায়ন করা
বাবা-মা কোনো ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা সন্তানের দায়িত্ব। এমন ওয়াদা যা তারা বেঁচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কোরআন মাজিদে বলা হয়েছে, আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। (সুরা বনি ইসরাঈল: ৩৪)
আরও পড়ুন: যেসব গুনাহের কারণে আল্লাহ রাগ করেন
৩. মা-বাবার আত্মীয় ও বন্ধুদের সঙ্গে সদাচরণ করা
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে দিনার (রা.) বলেন, মক্কার পথে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরের সঙ্গে এক ব্যক্তির দেখা হলো। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর তাকে সালাম করলেন, তাকে তার গাধায় চড়ালেন এবং নিজের মাথার পাগড়ি খুলে তাকে পরালেন। আমি তাকে বললাম, ওরা তো বেদুঈন, ওরা অল্পে তুষ্ট হয়। তিনি বললেন, এই ব্যক্তির বাবা আমার আব্বা ওমর ইবনুল খাত্তাবের প্রিয় বন্ধু ছিলেন। আমি রাসুল (স.)-কে বলতে শুনেছি, বাবার প্রিয়জনদেরকে সম্মান ও সদ্ব্যবহার করাই সবচেয়ে উত্তম ও সদ্ব্যবহার। (মুসলিম, আত-তারগিব ওয়াত তারহিব: ১২৬৮)
৪. মা-বাবার জন্য সদকা করা
মৃত মা-বাবার ঈসালে সওয়াবের জন্য সদকা করার শিক্ষা রয়েছে হাদিসে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা মৃত্যুবরণ করেছে। যদি আমি তার পক্ষে সদকা (দান) করি তাহলে এতে তার কোনো উপকার হবে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ। এরপর লোকটি বলল, আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আমার একটি ফসলের ক্ষেত তার পক্ষ থেকে সদকা করে দিলাম। (সুনানে নাসায়ি: ৩৫৯৫)
৫. হজ-ওমরা ও কোরবানির মাধ্যমে মা-বাবাকে সওয়াব পৌঁছানো
মৃত মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ, ওমরা, কোরবানি করেও সওয়াব উৎসর্গ করা যায়। (বুখারি: ১৮৫২; মুসলিম: ৫২০৩)
৬. মা-বাবার ঋণ পরিশোধ করা
বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তাদের ঋণ পরিশোধ করাও সন্তানের দায়িত্ব। জাবের (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নির্দেশে তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম এর ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। (বুখারি: ২৭৮১)
আরও পড়ুন: স্ত্রী ও বাবা-মা’র হক আদায়ে ভারসাম্য রক্ষার উপায়
৭. বাবা-মায়ের ভালো কাজ জারি রাখা, খারাপ কাজ বন্ধ করা
মৃত বাবা-মায়ের ভালো কাজগুলো জারি রাখার মাধ্যমেও বাবা-মায়ের সওয়াব জারি রাখা যায়। এতে নিজেরও সওয়াব লাভ হয়। হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের ভালো কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদের সওয়াব থেকে কোনো কমতি হবে না। (মুসলিম: ২৩৯৮)
মৃতব্যক্তি কোনো গুনাহের কাজ চালু করে গেলে তা সন্তান বন্ধ করবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোনো কমতি হবে না। (মুসলিম: ৬৯৮০)
৮. মা-বাবার ছুটে যাওয়া নামাজের ফিদিয়া আদায় করা
বাবা-মায়ের ছুটে যাওয়া নামাজ-রোজার জন্য প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে এবং প্রতি রোজার পরিবর্তে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম সদকা করা। ইকরিমা (রহ) বলেন, আমার মা প্রচণ্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে আমি তাউস (রহ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, প্রতিদিনের পরিবর্তে মিসকিনকে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম প্রদান করবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক: ৭৫৮১)
আরও পড়ুন: মা-বাবা শিরক করলে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে?
৯. মা-বাবার জন্য নফল নামাজ
সন্তান মৃত মা-বাবার জন্য নফল নামাজও আদায় করতে পারে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! জীবদ্দশায় আমি আমার মা-বাবার আনুগত্য করি। তাঁদের মৃত্যুর পর আমি তাঁদের আনুগত্য কীভাবে করব? তিনি বলেন, মৃত্যুর পর তাদের আনুগত্য হলো, তুমি নামাজ পড়ার সময় তাদের জন্য নামাজ পড়বে এবং তুমি রোজা রাখার সময় তাদের জন্য রোজা রাখবে। ’ (আওজাজুল মাসালিক ইলা মুয়াত্তা মালিক: পৃষ্ঠা-২৬৭)
১০. মা-বাবার কবর জিয়ারত করা
রাসুলুল্লাহ (স.) নিয়মিত মদিনার ‘বাকি’ কবরস্থান জিয়ারত করতেন। মৃত আপনজন, আত্মীয়-স্বজন ও সাহাবিদের জন্য দোয়া করতেন। চলার পথে কোনো কবর বা কবরস্থান পড়লেও মৃত ব্যক্তিদের জন্য দোয়া করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (স.) মদিনার একটি কবরস্থান অতিক্রম করার সময় তার দিকে ফিরে বলেন— ‘হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের মাফ করে দিন। তোমরা আমাদের অগ্রগামী, আমরা তোমাদের পদাঙ্ক অনুসারী। ’ (সুনানে তিরমিজি: ১০৫৩)
১১. মা-বাবার মানত পূরণ করা
মা-বাবা কোনো মানত করে গেলে, সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে—‘কোনো মহিলা রোজা রাখার মানত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর নিকট আসলে তিনি বললেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করো। (সহিহ ইবনে হিববান: ২৮০)
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেকের বাবা-মায়ের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিন। তাদের পরকার সুন্দর ও কল্যাণময় করুন, আমিন।

