ইতেকাফ আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক বিশেষ আমল। ইতেকাফের বিধান অনেক প্রাচীন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘরকে সেই সকল লোকের জন্য পবিত্র করো, যারা (এখানে) তাওয়াফ করবে, ইতেকাফ করবে এবং রুকু-সেজদা করবে।’ (সুরা বাকারা: ১২৫)
ইতেকাফ কী
‘ইতেকাফ’ আরবি শব্দ। এর অর্থ অবস্থান করা, নিজেকে কোনো স্থানে আবদ্ধ করে রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় ইতেকাফ মানে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করা। (উমদাতুল কারি, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা-১৪০) শরিয়তে ইতেকাফ হলো সুন্নতে মুয়াক্কাদা। (আল ইখতিয়ার লি তালিলিল মুখতার, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-১৩৬)
বিজ্ঞাপন
ইতেকাফ আল্লাহর উপহার
রমজানের বিশেষ ইবাদত ইতেকাফ। এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অসাধারণ মাধ্যম। আল্লাহ তাআলা রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফের বিধান রেখেছেন। এটি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বড় উপহার। গুনাহ মাফ ও জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম। ইতেকাফ জাহান্নাম থেকে আল্লাহর বান্দাকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স,) বলেন- ‘ইতেকাফকারী গুনাহকে প্রতিরোধ করেন। ইতেকাফকারীকে সকল নেক আমলকারীর ন্যায় নেকি দেওয়া হবে।’ (ইবন মাজাহ: ১৭৮১) অন্য হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতেকাফ করে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের আগুনের মাঝে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন; যা পূর্ব-পশ্চিমের চেয়েও বেশি দূরত্ব। (তাবারানি: ৭৪২০; হাকিম: ৪/২৬৯; বায়হাকি: ৩/৪২৪)
ইতেকাফ নবীজির নিয়মিত আমল
রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতেকাফ করা রাসুলুল্লাহ (স.)-এর একটি স্বতন্ত্র সুন্নত এবং এর চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে যে রাসুলুল্লাহ (স.) সর্বদা এর প্রতি যত্নবান ছিলেন। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। (বুখারি: ২০২৫)
আরও পড়ুন: রমজানে দুয়েক দিন ইতেকাফ করা যাবে?
ইতেকাফ নবীজির প্রিয় আমল
ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, অনেক আমল তো নবীজি (স.) কখনো করেছেন আবার কখনো ছেড়েও দিয়েছেন। কিন্তু মদিনায় হিজরত করার পর থেকে ওফাত পর্যন্ত রমজান মাসের শেষ ১০ দিনের ইতেকাফের আমলটি তিনি কখনোই ছেড়ে দেননি। অথচ বড়ই আশ্চর্য ও আফসোসের বিষয় হলো, এই মর্যাদাপূর্ণ আমলটির ব্যাপারে মানুষ তেমন গুরুত্ব দেয় না। (ফাতহুল বারি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা : ২৮৫) আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতিকাফ করতেন, কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফ করেছেন। (বুখারি: ২০৪৪)
বিজ্ঞাপন
নবীপত্নীরাও নিজ নিজ ঘরে ইতেকাফ করতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতিকাফ করতেন। তাঁর ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তাঁর সহধর্মিণীরাও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন। (বুখারি, হাদিস : ২০২৬)
নবীজি ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদর তালাশ করতেন
নবী (স.) লাইলাতুল কদর লাভের আশায় একবার রমজানের প্রথম ১০ দিন ইতেকাফ করেন। এরপর কয়েকবার ইতেকাফ করেন মাঝের দশ দিন। এরপর একসময় শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করতে শুরু করেন এবং ইরশাদ করেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর।’ (সহিহ বুখারি: ২০২০)
আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা লাভে ইতেকাফ উৎকৃষ্ট উপায়
ইতেকাফ আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন, দুনিয়াবিমুখতা এবং আল্লাহর রহমতে সিক্ত হওয়ার এক অনন্য উপায়। এই ইবাদতে ক্ষমা লাভ হয়। আর ইতেকাফকারী ব্যক্তির উদাহরণ দিতে গিয়ে আতা (রহ.) বলেন যে কোনো ব্যক্তি এসে কারো দরজায় কড়া নাড়ল এই বলে যে যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে কিছু না দেওয়া হবে, ততক্ষণ সে এখান থেকে এগোবে না। অনুরূপভাবে ইতেকাফকারী ব্যক্তিও আল্লাহ তাআলার দরজায় কড়া নাড়তে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ক্ষমা অর্জিত না হয়, ততক্ষণ সে আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয়ে ফিরে আসে না। (মারাকিল ফালাহ, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা-২৬৯)
আরও পড়ুন: ইতেকাফের গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা
ইতেকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.) বলেন, মসজিদে ইতিকাফ হচ্ছে হৃদয়ের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা ও চিত্তের নিষ্কলুষতা; চিন্তার পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাদের গুণাবলি অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণ লাভসহ সব ধরনের ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। এ জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ পালন করেছেন এবং তাঁর পূতঃপবিত্র বিবিগণসহ সাহাবায়ে কিরামের অনেকেই এই সুন্নতের ওপর আমৃত্যু আমল করেছেন। (হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ৪২)
ইতেকাফের স্থান
সওয়াবের দিক থেকে ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হল মসজিদে হারাম। এরপর মসজিদে নববী। তারপর মসজিদে আকসা। এরপর যেকোনো জামে মসজিদ। তারপর যেকোনো পাঞ্জেগানা মসজিদ। তবে নারীদের জন্য ইতিকাফের স্থান হল ঘরের নির্দিষ্ট কোনো স্থান। (দ্র. শরহু মুখতাসারিত তহাবি: ২/৪৭০; মাবসুত, সারাখসি: ৩/১১৫; বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৮০-২৮১; রদ্দুল মুহতার: ২/৪৬৯)
বিবাহিত নারীর ইতেকাফের ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি প্রযোজ্য। নারীদের মসজিদে ইতেকাফ করা বিষয়ে ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্য হলো- বর্তমান যুগ ফিতনা-ফ্যাসাদের যুগ। মসজিদে পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশার প্রবল আশঙ্কা এবং অনৈতিকতা, অশ্লীলতারও আশঙ্কা আছে। তাই বর্তমান যুগে নারীদের মসজিদে ইতেকাফ করা মাকরুহে তাহরিমি। (আল মাবসুত লিল সারাখসি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা-১১৫)