মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

বিজয় নিয়ে ইসলামি বিশ্বাস ও কর্মপন্থা কী

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৪৫ পিএম

শেয়ার করুন:

রমজানে নবীজির পারিবারিক জীবন যেমন কাটত

আল্লাহ তাআলার মনোনীত দ্বীন ইসলাম। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই দ্বীন সঠিক পথনির্দেশনা দেয়। এই দ্বীনকে বিজয়ী করতে মুসলমানদের সর্বাত্মক চেষ্টা ও সংগ্রাম করতে হয়। ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা বিজয় দান করেন। 

বিজয় লাভ হয় আল্লাহর সাহায্যে
বিজয়ের ব্যাপারে ইসলামি আকিদা হলো- এটি আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ না হলে বিজয় অর্জন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- قَالَ الَّذِیْنَ یَظُنُّوْنَ اَنَّهُمْ مُّلٰقُوا اللهِ كَمْ مِّنْ فِئَةٍ قَلِیْلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِیْرَةًۢ بِاِذْنِ اللهِ  وَ اللهُ مَعَ الصّٰبِرِیْنَ ‘যারা দৃঢ় বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের মিলিত হতে হবে, তারা বলতে লাগল, কত ক্ষুদ্র দল আল্লাহর হুকুমে বড় দলের উপর জয়ী হয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা: ২৪৯)


বিজ্ঞাপন


উল্লেখিত আয়াতে বিজয়ের ব্যাপারে সঠিক আকিদা পোষণকারীদের প্রশংসা করা হয়েছে। যারা শত্রুপক্ষকে বড় দেখেও হতাশ হননি, বরং সবরের সঙ্গে লড়াই করেছেন। ফলে আল্লাহ তাআলা তাদের বিজয় দিয়েছেন। সুতরাং বিজয়ের পর কোনো ব্যক্তির ক্রেডিট নেওয়া উচিত নয়। এটি ইসলামি শিক্ষার বিপরীত। বরং সব ক্রেডিট মহান আল্লাহর, যিনি দয়া করে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকেও নাস্তানাবুদ করে দেন।

বিজয় লাভের পর আল্লাহর শুকরিয়া ও ইস্তেগফার
বিজয় লাভ হলে মুমিনের প্রথম কর্তব্য হলো- আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং ইস্তেগফার করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- اِذَا جَآءَ نَصْرُ اللهِ وَ الْفَتْحُ، وَ رَاَیْتَ النَّاسَ یَدْخُلُوْنَ فِیْ دِیْنِ اللهِ اَفْوَاجًا،فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَ اسْتَغْفِرْهُ  اِنَّهٗ كَانَ تَوَّابًا ‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে এবং লোকদের দেখবেন তারা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। তখন আপনি স্বীয় রবের স্বপ্রশংস তাসবীহ পাঠ করতে থাকবেন এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল’ (সুরা নাসর: ১-৩)

মক্কা বিজয়ের পর নবী (স.) কাবা গৃহে প্রবেশ করে মহান আল্লাহর দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। তিনি দীর্ঘক্ষণ সেখানে অবস্থান করেন, নামাজ পড়ে মহান আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন। (বুখারি: ২৯৮৮)

আরও পড়ুন: ষড়যন্ত্রকারীদের কেমন শাস্তি দিতে বলে ইসলাম


বিজ্ঞাপন


বিজয়ের পর বিনয় ও তাকওয়ার গুণ ধারণ করা
আল্লাহর ইচ্ছায় বিজয় লাভের পর প্রজাদের ব্যাপারে বিনয়ী হওয়া এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করা মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বিশৃঙ্খল ও ঔদ্ধত্য জাতীকে পছন্দ করেন না। বরং শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও ন্যায়নিষ্ঠ বান্দাদের পুরস্কৃত করে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে- تِلْكَ الدَّارُ الْاٰخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِیْنَ لَا یُرِیْدُوْنَ عُلُوًّا فِی الْاَرْضِ وَ لَا فَسَادًا  وَ الْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِیْنَ ‘ওই পরকালীন নিবাস আমি তাদের দেব, যারা জমিনের বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। আর শুভ পরিণাম আল্লাহভীরুদের জন্য।’ (সুরা কাসাস: ৮৩)

বিজয়ের পর আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলা মুমিনের দায়িত্ব
বিজয় অর্জিত হওয়ার পর মুমিন বান্দাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো- যিনি বিজয় দিয়েছেন তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা। যিনি ভূখণ্ড দিয়েছেন তাঁর বিধান নিজেদের জীবনে এবং সমাজের সব অঙ্গনে বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর নেক ও অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন- اَلَّذِیْنَ اِنْ مَّكَّنّٰهُمْ فِی الْاَرْضِ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتَوُا الزَّكٰوةَ وَ اَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَ نَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ  وَ لِلهِ عَاقِبَةُ الْاُمُوْرِ ‘তারা এমন যে, আমি তাদের পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করলে তারা নামাজ কায়েম করবে। জাকাত প্রদান করবে এবং সৎকর্মের আদেশ দেবে এবং অসৎকার্য থেকে নিষেধ করবে। আর সবকিছুর পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে।’ (সুরা হজ: ৪১)

বিজিত অঞ্চল গুনাহ ও নাফরমানি থেকে মুক্ত রাখা চাই
বিজয়ের পর সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি হলো- আল্লাহপ্রদত্ত ভূখণ্ডকে গুনাহ ও নাফরমানি থেকে মুক্ত রাখা। কেননা গুনাহ যখন ব্যাপক আকার ধারণ করে, আল্লাহর নাফরমানি সীমা অতিক্রম করে, তখন ভূখণ্ডের অধিবাসীদের উপর ধ্বংস নেমে আসে। বিভিন্ন কল্যাণ ও বরকত থেকে তাঁরা বঞ্চিত হয়ে যায়, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে এই বিজয় পরাজয়েও রূপান্তরিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- وَ اِذَاۤ اَرَدْنَاۤ اَنْ نُّهْلِكَ قَرْیَةً اَمَرْنَا مُتْرَفِیْهَا فَفَسَقُوْا فِیْهَا فَحَقَّ عَلَیْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنٰهَا تَدْمِیْرًا ‘আমি যখন কোনো জনপদ ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন তার ঐশ্বর্যশালী লোকদের (ঈমান ও সৎকর্মের) আদেশ করি। কিন্তু ওরা সেখানে অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়, ফলে সেই জনপদের ব্যাপারে (শাস্তির) কথা অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমি তা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে দেই।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ১৬)

বিজিত অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য দোয়া করা
বিজয় অর্জিত হওয়ার পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দেশে শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা এবং জনগণের ঈমান-আকিদা হেফাজতের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা। যেমনটা করেছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.। পবিত্র কোরআনের ভাষায়- وَ اِذْ قَالَ اِبْرٰهِیْمُ رَبِّ اجْعَلْ هٰذَا الْبَلَدَ اٰمِنًا وَّ اجْنُبْنِیْ وَ بَنِیَّ اَنْ نَّعْبُدَ الْاَصْنَامَ ‘স্মরণ কর, যখন ইবরাহিম বললেন, হে আমার রব! এই শহরকে করুন নিরাপদ এবং আমাকে ও আমার সন্তান-সন্ততিকে প্রতিমার পূজা থেকে দূরে রাখুন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩৫)

আরও পড়ুন: ইসলামে সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের সুযোগ নেই

বিজয় ধরে রাখতে হবে
বিজয় অর্জন এক জিনিস। বিজয় অক্ষুণ্ন রাখা আরেক জিনিস। প্রত্যেক মুসলিম নাগরিকের দায়িত্ব হলো- নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ সজাগ দৃষ্টি রাখা। নতুবা স্পেন, ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, আরাকানের ভাগ্য-বিপর্যয় আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। মিসর বিজেতা বিখ্যাত সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.) মুসলিম উম্মাহকে এই দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন- أنتم في رباط دائم إلى يوم القيامة لكثرة الأعداء حولكم وتشوق قلوبهم إليكم ‘কেয়ামত পর্যন্ত তোমাদেরকে সর্বদা এই ভূখণ্ডের পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতে হবে। কেননা তোমাদের চারপাশে অসংখ্য শত্রু ওত পেতে আছে।... (আননুজুমুজ জাহিরাহ ফি মুলুকি মিস্র ওয়াল কাহিরাহ: ১/৯২)

বিজয়ের পর সাহাবির কান্না ও মুসলিমদের জন্য শিক্ষা
হজরত উসমান (রা.)-এর শাসনামলে ২৮ হিজরি সনে সাইপ্রাস দ্বীপের উপর মুসলিমদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিজয়ের পর দেখা গেল সবাই আনন্দে উদ্বেলিত, কিন্তু একজন মানুষ ক্রন্দনরত। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুলের বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবুদ দারদা (রা.)। তখন জুবাইর ইবনে নুফাইর তাঁকে জিজ্ঞাসা করল আপনি কেন কাঁদছেন? অথচ আজ আল্লাহ তাআলা ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে সম্মানিত করেছেন। তিনি বললেন, আফসোস তোমার প্রতি! নিশ্চয়ই এই জাতি ছিল বড় প্রতাপশালী জাতি। তাদের ছিল অনেক বড় রাজত্ব। কিন্তু যখন তারা আল্লাহর হুকুম নষ্ট করল তখন তিনি তাদের এই পরিণতি ঘটালেন, যা তুমি দেখতে পাচ্ছ। আল্লাহর বান্দারা যখন আল্লাহর বিধান পরিত্যাগ করে তখন তারা কীভাবে অপদস্থ হয়ে যায়! (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া, ফাতহু কুবরুস অধ্যায়: ৭/১১০)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে দ্বীন কায়েমের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের তাওফিক দান করুন। বিজিত অঞ্চলে নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃঙ্খলা দান করুন। বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে নবীজি ও সাহাবিদের জীবনী থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর