ইসলামে সন্ত্রাস, বোমাবাজি, ফিতনা-ফাসাদসহ সব প্রকার আত্মঘাতী তৎপরতার স্থান নেই। ইসলামের নির্দেশনা হলো—সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থা পরিহার করে ভারসাম্যপূর্ণ মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। মানবসমাজ থেকে ফিতনা-ফাসাদ জুলুম-অনাচার দূর করে ন্যায় ও ইনসাফের সমাজ উপহার দেওয়া ইসলামের অন্যতম লক্ষ্য। এজন্যই যুগে যুগে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দুনিয়াতে বহু নবী-রাসুল (স.) প্রেরণ করেছেন। যারা অন্ধকার জগতের বাসিন্দাদের ফিরিয়ে এনেছেন আলোর পথে।
প্রকৃতপক্ষে সন্ত্রাসীদের কোনো ধর্ম নেই। তাদের ধর্মই হচ্ছে রক্তপাত করা। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা মানে পুরো মানবজাতিকে হত্যা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এই কারণেই বনি ইসরাইলিদের এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করার কারণ ছাড়া যদি কেউ কাউকে হত্যা করে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)
বিজ্ঞাপন
আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘ফিতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধ) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর পাপ’ (সুরা বাকারা: ১৯১)
পরকালে সন্ত্রাসী ও ফিতনা-ফাসাদকারীদের কঠিন শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে, তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। আল্লাহ তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, তাকে অভিসম্পাত করেছেন এবং তার জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ভয়ংকর শাস্তি।’ (সুরা নিসা: ৯৩)
আরও পড়ুন: বিয়ের উদ্দেশ্যে প্রেম করা জায়েজ?
মহানবী (স.) বলেছেন, ‘কেয়ামত দিবসে সর্বপ্রথম রক্তপাত তথা হত্যার বিচার হবে’ (বুখারি: ৬৫৩৩)। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোনো কাফেরকে (জিম্মিকে) হত্যা করবে, সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ চল্লিশ বছর দূরের পথ হতেও পাওয়া যাবে।’ (বুখারি: ৩১৬৬)
বিজ্ঞাপন
উপরোক্ত দলিল-প্রমাণ দ্বারা এ কথাই স্পষ্ট হলো, ইসলাম সর্বপ্রকারের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। যেকোনো ধরনের ফিতনা-ফাসাদ—চাই তা যেখানেই হোক না কেন বা যার সঙ্গেই হোক না কেন, এগুলোকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে।
মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। পদে পদে মানুষকে পরনির্ভর ও পরমুখাপেক্ষী হতে হয়। তথাপি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, আদর্শিক লড়াইয়ে, পার্থিব দুনিয়ার মোহগ্রস্ত হয়ে মানুষ সংঘাতে লিপ্ত হয়। বোমাবাজি ও সন্ত্রাস করে রক্তের হোলিখেলায় মেতে ওঠে। পূর্ণ ইসলাম মেনে না চলার কারণেই মানুষ সন্ত্রাসী হয়। অথচ ইসলাম অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকেও হত্যায় উৎসাহিত করে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করে না, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে না।’ (সুরা ফুরকান: ৬৮)
কেউ অন্যায়ভাবে হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হলে ইসলাম তার জন্য মৃত্যুদণ্ড বা কিসাস আইন প্রবর্তন করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের জন্য কিসাসের বিধান দেওয়া হলো।’ (সুরা বাকারা: ১৭৮)
আরও পড়ুন: বেশি মানুষ বেহেশতে যাবে যে দুই কারণে
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে গোটা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো মুসলমানের হত্যার চেয়ে অধিক সহনীয়’ (নাসায়ি: ৩৯৯২)। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে, একদল মুসলিম অন্য দলের ওপর অস্ত্রাঘাত করছে। অথচ রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের (মুসলমানদের) ওপর অস্ত্র উঠাবে, সে আমাদের (ধর্মের) দলভুক্ত না।’ (বুখারি: ৬৮৪৪)
এভাবেই ইসলাম হত্যা, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কেউ নির্যাতন করলে, হত্যার জন্য এগিয়ে এলে তখন সবার উচিত নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন (বিশ্বের) সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)
ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে, তখন ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করবে।’ (সুরা নিসা: ৫৮)
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অর্থের জোর, ক্ষমতার দাপট ও রক্তের বন্ধন উপেক্ষা করতে কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ, যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন। আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর।’ (সুরা নিসা: ১৩৫)
তবে বলপ্রয়োগ যেন অন্যায়ভাবে বিদ্বেষপ্রসূত না হয়; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনো সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে।’ (সুরা মায়েদা: ৮)
সুবিচার যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য গণমানুষের প্রতিনিধিরা পরস্পর সলাপরামর্শ করবেন। যা খোলাফায়ে রাশেদিন অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। সংলাপ, পরস্পর বোঝাপড়া ও পরামর্শের প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাদের যাবতীয় কাজকর্ম নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক পরামর্শ নিয়ে সাধিত হয়।’ (সুরা শুরা: ৩৩)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করো।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৫৯)
কোরআনের এসব বাণী বুকে ধারণ করেই সাহাবায়ে কেরাম রাষ্ট্রীয় সংকট নিরসন করেছেন। হজরত ওমর (রা.) মজলিসে শুরায়ে আম ও খাস নামে পৃথক দুটি পরামর্শ পরিষদ গঠন করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাধান করতেন। হজরত ওসমান (রা.) বারবার বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সংলাপে বসেন। তবুও তিনি দমন-পীড়ননীতি অনুসরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেননি। হজরত আলী (রা.) ও হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর মধ্যকার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তিও ঘটে পরস্পর সন্ধি স্থাপনের মাধ্যমে। কেননা দুই পক্ষের সামান্য উদারতা বহু মানুষের জান-মাল ও জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে পারে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, ফেতনা ফাসাদ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাওফিক দান করুন। অবিচার ও বিচারবহির্ভূত হত্যা থেকে পুরো জাতিকে হেফাজত করুন। আমিন।