একদিন পৃথিবীর আয়ু শেষ হয়ে যাবে। কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের মাধ্যমে সৃষ্টিকূল ধ্বংস হয়ে যাবে। ইসলামি পরিভাষায় ‘কেয়ামত বলা হয় ওই দিনকে, যেদিন সৃষ্টিকুল ধ্বংস হবে এবং যেদিন লোকেরা তার রবের সামনে দাঁড়াবে। (রুহুল মাআনি: ৫/১২২)
পবিত্র কোরআন বলছে, সেই দিনটি বেশি দূরে নয়। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে কেয়ামত সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে আল্লাহ তাআলা ওহি নাজিল করে বলেন, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন; কিন্তু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (সুরা আম্বিয়া: ১)
বিজ্ঞাপন
কেয়ামতের আগে ছোট-বড় কিছু নিদর্শন প্রকাশ পাবে। এসব নিদর্শনের মধ্যে মানুষের ব্যতিক্রম জীবনাচার নিয়ে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে। নিচে সেগুলো তুলে ধরা হলো।
ধন-সম্পদের পেছনে সময় ব্যয়
কেয়ামতের আগে মানুষ ধন-সম্পদের পেছনে বেশি সময় অতিবাহিত করবে। মানুষের মধ্যে ধন-সম্পদ বেড়ে যাবে। এর পরিমাণ কত হবে—সেই উদাহরণ দিতে গিয়ে নবীজি বলেছেন, ‘কেয়ামত ততক্ষণ সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না তোমাদের মধ্যে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়ে উপচে না পড়বে, এমনকি সম্পদের মালিকগণ তার সদকা কে গ্রহণ করবে তা নিয়ে চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়বে। যাকেই দান করতে চাইবে সে-ই বলবে, প্রয়োজন নেই।’ (সহিহ মুসলিম: ১৪১২) বস্তুত কেয়ামতের আগে মানুষ হালাল-হারামের তোয়াক্কা করবে না। আমানতকে নিজ সম্পদ বলে গণ্য করবে, জাকাত দেওয়াকে অত্যন্ত ভারি বোধ করবে। সুদ-ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি-ডাকাতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে। এক কথায়, ‘এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ উপার্জনের ক্ষেত্রে হারাম-হালাল বিবেচনা করবে না।’ (বুখারি: ২০৫৯)
অশ্লীলতায় মগ্ন
মানুষ বেহায়াপনায় এতই ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে, আল্লাহর আজাবস্বরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাবে। চারিত্রিক অধপতনের কারণে মানুষ পিতা-মাতার আদেশ লঙ্ঘন করবে। সামাজিক রীতি ও মূল্যবোধ পাল্টে যাবে। হাদিস শরিফে এসেছে, নিশ্চয়ই এসব কেয়ামতের আলামত যে একসময় কৃপণতা ও অশ্লীলতা প্রকাশ পাবে। খিয়ানতকারীকে আমানতদার মনে করা হবে। আমানতদারকে খিয়ানতকারী মনে করা হবে। নারীদের নতুন নতুন পোশাকের উদ্ভব ঘটবে, যেগুলো পরিধান করে নারীরা বস্ত্রাবৃত হয়েও নগ্ন থাকবে। নিকৃষ্ট লোকেরা অভিজাত লোকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে। (তাবরানি আওসাত: ৭৪৮৯) অন্য বর্ণনায় এসেছে, নারীরা বাহ্যিক সৌন্দর্য ও অলংকারে মোড়ানো থাকলেও বস্তুত তারা নগ্নই থাকবে। তারা এতই পাতলা কাপড় পরিধান করবে যে দেহের অভ্যন্তরীণ অংশ দেখা যাবে। (শরহে নববী: ১৭/১৯০-১৯১; মেরকাত : ৬/২৩০২)
বিজ্ঞাপন
মাদকদ্রব্য সেবন বেড়ে যাবে
কেয়ামতের আগে মাদকতার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়বে। মাদক সেবনকে অপরাধই মনে করা হবে না। আনাস (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি যে ‘কেয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে রয়েছে ইলম উঠে যাবে, মূর্খতা, ব্যভিচার ও মদ পান বেড়ে যাবে। পুরুষের সংখ্যা হ্রাস পাবে এবং নারীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এমনকি ৫০ জন নারীর পরিচালক হবে একজন পুরুষ।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩৩৮৪)
মানুষ হত্যা
মানুষে মানুষে খুনাখুনি কেয়ামতের অন্যতম আলামত। ছোটখাটো বিষয়েও মানুষ মানুষকে খুন করবে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যখন কেয়ামত সন্নিকট হবে তখন আমল কমে যাবে, অন্তরে কৃপণতা ঢেলে দেওয়া হবে এবং হারজ বেড়ে যাবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হারজ কী? তিনি বলেন, ব্যাপক হত্যাকাণ্ড।’ (বুখারি: ৬০৩৭) অন্য হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, ‘সেই সত্তার শপথ! যাঁর হাতে আমার জীবন, দুনিয়া ধ্বংস হবে না যে পর্যন্ত না মানুষের কাছে এমন এক যুগ আসে, যখন হত্যাকারী জানবে না যে কি দোষে সে অন্যকে হত্যা করেছে এবং নিহত লোকও জানবে না যে কি দোষে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হলো, কিভাবে এমন অত্যাচার হবে? তিনি জবাবে বলেন, সে যুগটা হবে হত্যার যুগ। এরূপ যুগের হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়েই জাহান্নামি হবে।’ (মুসলিম: ৭১৯৬)
বিলাসিতা ও অপচয়
কেয়ামতের আগে মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ-সম্পদ থাকবে। বিলাসিতা ও অপচয় বেড়ে যাবে। মানুষ দামী দামী জিনিসপত্র সঙ্গে রাখবে। গর্ব করবে অট্টালিকার উচ্চতা আর ভোগের সামগ্রী ও আসবাব নিয়ে। যদিও তারা ফকির ছিল ও দুঃখ-কষ্টে জীবন কাটাত এবং তারা অন্যের দয়ায় জীবন যাপন করত। যেমনটি রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘দাসি তার মনিবকে প্রসব করবে, তুমি দেখতে পাবে যাদের পায়ে জুতা এবং পরনে কাপড় নেই, নিঃস্ব ও বকরির রাখাল তারা উঁচু উঁচু প্রাসাদ তৈরিতে পরস্পর প্রতিযোগিতা করছে।’ (সহিহ মুসলিম: ৮)
আরও পড়ুন: অপচয় ও কৃপণতার মাঝামাঝিতে থাকবেন যেভাবে
নেতৃত্বের লোভ
কেয়ামতের আগে অধিকাংশ মানুষ হবে মূর্খ। আর তাদের মধ্যে নেতৃত্বের লোভ থাকবে। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে তখন কেয়ামতের অপেক্ষা করবে। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমানত কীভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? তিনি বলেন, যখন কোনো দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করা হবে, তখনই কেয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (বুখারি: ৬৪৯৬)
মসজিদে শোরগোল করবে মানুষ
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন লোকেরা আল্লাহর সম্পদকে (যুদ্ধলব্ধ মাল) নিজের সম্পত্তি মনে করবে, আমানতকে নিজ সম্পদ বলে গণ্য করবে, জাকাত দেওয়াকে অত্যন্ত ভারি বোধ করবে, ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া অন্য জ্ঞান শিখবে, পুরুষরা নারীদের তাঁবেদারি করবে, সন্তান নিজ মায়ের নাফরমানি করবে, বন্ধুবান্ধবকে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বলে ধারণা করবে, আর নিজ পিতাকে দূরবর্তী লোক বলে বুঝবে, মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে দুনিয়াবি কথাবার্তা হবে, পাপী লোক সমাজের সর্দার হবে, নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোক সমাজের প্রাধান্য ও কার্যভারপ্রাপ্ত হবে, জালিমকে তার জুলুমের ভয়ে মানুষ সম্মান করবে, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্র প্রচুর পরিমাণে বিস্তার লাভ করবে, মদপান বেড়ে যাবে, পরবর্তী লোকেরা পূর্বপুরুষদের মন্দ বলবে, তখন তোমরা এমন বিপদের অপেক্ষা করতে থাকবে যে লালবর্ণের প্রচণ্ড বায়ু বা ভূমিকম্প হবে। জমিন দেবে যাবে। লিঙ্গের রূপান্তর হবে। আসমান থেকে পাথর বর্ষণ হবে। আরো অনেক আপদ-বিপদ তাড়াতাড়ি এমনভাবে উপর্যুপরি আসতে থাকবে, যেভাবে মণিমুক্তার মালা ছিঁড়ে গেলে দানাগুলো ধারাবাহিক খসে পড়তে থাকে।’ (তিরমিজি: ২২১০; বুখারি: ৮১)
আরও পড়ুন: মসজিদে হট্টগোল, নবীজি যা বলেছেন
গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকবে মানুষ
কেয়ামতের একটি বিশেষ আলামত হলো- গান-বাজনা বেড়ে যাওয়া। নবীজি বলেছেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার উপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা রমনীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জমিনে ধসিয়ে দিবেন। আর তাদের কিছুকে বানর ও শূকর বানিয়ে দিবেন। (ইবন মাজাহ: ৪০২০ সহিহ ইবনে হিব্বান ৬৭৫৮) অন্য হাদিসে নবীজি বলেছেন, ‘অচিরেই শেষ যুগে দেখা দিবে ভূমি ধস, নিক্ষেপ ও বিকৃতি। রাসুলুল্লাহ (স.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! তা কখন? তিনি বললেন, যখন বাদ্যযন্ত্র ও গায়ক-গায়িকারা বেশি হারে প্রকাশ পাবে। (ইবনু মাজাহ: ২/১৩৫০)
দ্বীনি জ্ঞানার্জনকে সময় নষ্ট মনে করবে
আসমানি জ্ঞান অর্জনকে মানুষ সময় নষ্ট মনে করবে। পড়ালেখা করলেও তা দ্বীনকে ভালোভাবে বুঝার জন্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করবে না। একসময় আলেমদের সংখ্যই কমে যাবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আল্লাহ বান্দাদের থেকে হঠাৎ করে ইলম উঠিয়ে নেবেন না; বরং ইলম উঠিয়ে নেবেন ওলামাদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। একপর্যায়ে যখন একজন সত্যপন্থী আলেমও থাকবে না, তখন লোকেরা মূর্খদের তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে। এই মূর্খরা ধর্মীয় বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হলে অজ্ঞতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত দেবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে। (বুখারি: ১০০)
কেয়ামতের আগে এরকম নানাধরনের ফিতনার আত্মপ্রকাশ হবে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কারো কারো জন্য দ্বীনের ওপর অটল-অবিচল থাকা কঠিন হয়ে উঠবে। হাদিসের ভাষায়, ‘..যখন দ্বীনের ওপর অবিচল থাকা হাতের মধ্যে জ্বলন্ত অঙ্গার রাখার মতো কঠিন হবে।’ (তিরমিজি: ২২৬০)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হেদায়াত করুন। নানারকম ফিতনা থেকে হেফাজতে থাকার তাওফিক দান করুন। ঈমানের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।