শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

নবীজির দাদা যেভাবে নিশ্চিহ্ন জমজমের সন্ধান পেয়েছিলেন 

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:৫৭ পিএম

শেয়ার করুন:

নবীজির দাদা যেভাবে নিশ্চিহ্ন জমজমের সন্ধান পেয়েছিলেন 

হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে মক্কার মরুভূমিতে নিজের শিশুসন্তান ইসমাইল (আ.) ও স্ত্রী হাজেরা (আ.)-কে রেখে এসেছিলেন। খাবার দাবার ও পানি শেষ হয়ে গেলে একসময় ইসমাইল (আ.) তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। পানির সন্ধানে মা হাজেরা হন্যে হয়ে সাফা-মারওয়া দৌড়েছিলেন। কিন্তু পানি পাননি। একসময় শিশু ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের আঘাতে সৃষ্টি হয়েছিল জমজম কূপ। পরবর্তীতে মক্কায় বসবাসকারী বিভিন্ন গোত্র ও সম্প্রদায় কূপটি নিয়ন্ত্রণ করে। জুরহুম নামে একটি গোত্র মক্কা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পায়। 

এ সময় খুজাআ নামক একটি গোত্র মক্কায় আক্রমণ করে। আক্রমণের সময় জুরহুম গোত্র মক্কা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পালিয়ে যাওয়ার আগে তারা জমজম কূপের মুখ ঢেকে দিয়ে যায়, (যাতে খুজাআ গোত্র মক্কায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস ও পানি পান করতে না পারে) এবং কাবার ভেতর রক্ষিত সব সোনাদানা লুকিয়ে রেখে পলায়ন করে। এরপর সংস্কারের অভাবে একসময় জমজম কূপের স্থান মাটিতে ভরাট হয়ে যায়। এভাবেই কালের আবর্তে এক সময় কূপটি মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। মানুষ কূপটির কথাও ভুলে যায়। 


বিজ্ঞাপন


পরবর্তীতে কূপটি খনন করে পুনরুদ্ধার করেন আমাদের নবীজির দাদা আব্দুল মুত্তালিব। সেসময় তিনি ছিলেন কুরাইশদের গোত্রপ্রধান। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখলেন, তাকে জমজম কূপ খনন করতে বলা হচ্ছে এবং স্বপ্নেই তাকে কূপের জায়গাটি নির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঘুম ভাঙার পর আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নের বিষয়টি কয়েকবার ভাবেন। এরপর নিজের বড় ছেলে হারিসকে নিয়ে স্বপ্নের দেখানো জায়গায় জমজম কূপ খননের কাজ শুরু করেন। কূপ খননের সময় এখান থেকে তিনি কিছু তলোয়ার, লৌহবর্ম ও দুইটি সোনার হরিণ পেয়েছিলেন। আব্দুল মুত্তালিব তলোয়ারগুলো দিয়ে কাবা ঘরের দরজা ঢালাই করেন, সোনার হরিণ দুটি দরজার সঙ্গে সন্নিবেশিত করে রাখেন।

আরও পড়ুন: হাজরে আসওয়াদের ঐতিহাসিক তথ্য

খনন কাজ করতে করতে এক সময় আব্দুল মুত্তালিব আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে ফেললেন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, আমি পেয়েছি, আমি পেয়েছি! মক্কাবাসী দেখ, আমি জমজম কূপ খুঁজে পেয়েছি! আব্দুল মুত্তালিবকে ঘিরে ধরল মক্কার বিভিন্ন গোত্র। বলল— আব্দুল মুত্তালিব! এটা আমাদের পূর্বপুরুষ ইসমাইল (আ.)-এর কূপ। কাজেই আমরা সবাই এটার অংশীদার।


বিজ্ঞাপন


আব্দুল মুত্তালিব বললেন— না, এই কূপ আল্লাহ আমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছেন। আমি তোমাদের সবাইকে পানি দেব, কিন্তু এর মালিকানা আমার থাকবে। বাকিরা কিছুইতে আব্দুল মুত্তালিবের কথা মানতে রাজি হলো না। এ নিয়ে অনেক তর্কবির্তক হলো। বিষয়টির সমাধানে আব্দুল মুত্তালিব বললেন– শোনো! চলো আমরা সবাই মিলে একজন জ্ঞানী মানুষের কাছে যাই যিনি আমাদের এই ঝগড়ার সুরাহা করে দেবেন।

সবাই পরামর্শক্রমে বনু সাদ গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তিনি অনেক দূরে থাকতেন। সবাই মিলে তার কাছে রওনা হলেন। তার কাছে যাওয়ার সময় মরুভূমিতে কাফেলার কাছে থাকা সব পানি শেষ হয়ে গেল। কারো কাছে খাওয়ার মতো কোনো পানি অবশিষ্ট থাকলো না। নির্জন মরুপ্রান্তরে পানি ছাড়া জীবন বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। এদিকে অনেক খোঁজাখোঁজি করেও পানির কোনো হদিস মিললো না। মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে কাফেলার সবাই মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগলো। মৃত্যুর পর প্রাণী-পাখিদের কবল থেকে লাশ রক্ষা করতে সবাই নিজের জন্য কবর খুঁড়ে রাখলো, যেন কেউ মারা গেলে অন্তত অন্যরা দাফন করতে পারে।

এই কঠিন মুহূর্তে আব্দুল মুত্তালিব বলে উঠলেন– আল্লাহর কসম! এভাবে মৃত্যুর কাছে হার মানার কোনো মানে হয় না। হয়তোবা আল্লাহ আমাদের জন্য অন্য কোথাও পানি রেখেছেন, চলো আমরা আবার চলা শুরু করি! এই বলে যেই মাত্র আব্দুল মুত্তালিব তার উটের পিঠে চড়েছেন, উট তখন ঝটকা মেরে মাটিতে খুর দিয়ে আঘাত করল– আল্লাহর কুদরতে বালুর ভেতর থেকে ফিনকি দিয়ে পানি বের হওয়া শুরু হলো।

আরও পড়ুন: ‘মাকামে ইবরাহিম’ আল্লাহর কুদরতের অনন্য নিদর্শন

সবাই অবাক হয়ে বলে উঠলো—ওটা কী আব্দুল মুত্তালিব! ওটা কী? তুমি আরেকবার আরেকটা কূপের সন্ধান পেয়ে গেছ! সবাই যেন নিজের জীবন ফিরে পেল! প্রাণ ভরে পানি পান করে পানির পাত্রগুলো ভরে নিলো।

এ ঘটনার পর কুরাইশবাসীর মন পাল্টে গেল। তারা ভাবল এটা নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো ইশারা, তাই তো এই নির্জন মরুভূমিতে আবারো পানির সন্ধান পেলেন আব্দুল মুত্তালিব। তাই জমজমের দায়িত্ব আব্দুল মুত্তালিবকেই দেওয়া যুক্তিযুক্ত। তখন তারা সমস্বরে বলে উঠল— যে আল্লাহ তোমাকে মরুভূমিতে এই পানির সন্ধান দিয়েছেন, তিনিই তোমাকে জমজম দিয়েছেন। এরপর তারা সমাধানের জন্য সেই ব্যক্তির কাছে না গিয়ে মক্কায় ফিরে গেল এবং জমজমের মালিকানা আব্দুল মুত্তালিবকে ছেড়ে দিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৪২-১৪৭)

এ পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল মুত্তালিব মানত করেছিলেন যে আল্লাহ তাআলা যদি অনুগ্রহ করে তাঁকে ১০টি পুত্রসন্তান দান করেন এবং সবাই বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে জীবনের এ স্তরে গিয়ে পৌঁছে যে তাঁরা আত্মরক্ষা করতে সক্ষম, তাহলে তিনি তাঁর একটি সন্তানকে বায়তুল্লাহর জন্য উৎসর্গ (কোরবানি) করবেন। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৪২-১৪৭)

আবদুল মুত্তালিব ছেলেদের মধ্যে কাকে কোরবানি করা যায়—এ ব্যাপারে লটারি দেন। লটারিতে আবদুল্লাহর নাম উঠে যায়। আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহর হাত ধরে তাঁকে নিয়ে যান কাবার কাছে। তাঁর হাতে ছিল জবেহ করার ধারালো অস্ত্র। কিন্তু কোরাইশদের মধ্যে বনু মাখজুম অর্থাৎ আবদুল্লাহর নানা গোষ্ঠীর লোকজন এবং আবদুল্লাহর ভাই আবু তালিব এ ব্যাপারে তাঁকে বাধা প্রদান করেন।

আরও পড়ুন: রিয়াজুল জান্নাহ: পৃথিবীতে এক টুকরো জান্নাত

মানত পূরণের বিকল্প পদ্ধতি জানতে আবদুল মুত্তালিব জনৈক তত্ত্ববিশারদের পরামর্শ চান। তিনি আবদুল্লাহ এবং ১০টি উটের মধ্যে নির্বাচনগুটিকা ব্যবহারের পরামর্শ দেন। নির্বাচনী গুটিকায় যদি আবদুল্লাহর নাম উঠে যায় তাহলে ১০টি উটের সঙ্গে আরো ১০টি উট যোগ করে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করতে হবে যে পর্যন্ত না আবদুল্লাহর নামের স্থানে ‘উট’ কথাটি প্রকাশিত হয় সে পর্যন্ত একই ধারায় নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে হবে, যতক্ষণ না আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে যান। তারপর উটের যে সংখ্যা নির্ধারক নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করা হবে সেই সংখ্যক উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করতে হবে। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবদুল মুত্তালিব, আবদল্লাহ ও ১০টি উটের মধ্যে নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতে আবদুল্লাহর নামই প্রকাশিত হয়।

তত্ত্ববিশারদের নির্দেশ মোতাবেক দ্বিতীয় দফায় উটের সংখ্যা আরো বেশি বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করেন। কিন্তু এতেও আবদুল্লাহর নামই উঠে যায়। কাজেই পরবর্তী প্রত্যেক দফায় ১০টি উটের সংখ্যা বৃদ্ধি করে তিনি নির্বাচনী গুটিকা ব্যবহার করে যেতে থাকেন। এ ধারায় চলতে চলতে যখন এক শ উট এবং আবদুল্লাহর নাম নির্বাচনী গুটিকায় ব্যবহার করা হয়, তখন উট কথাটি প্রকাশিত হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আবদুল মুত্তালিব আবদুল্লাহর পরিবর্তে ১০০ উট আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন। আর এ জন্যই রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘আমি দুই জবেহ (উৎসর্গকৃত)-এর সন্তান, একজন ইসমাঈল (আ.) এবং অন্যজন আমার পিতা আবদুল্লাহ। (রহমাতুল্লিল আলামিন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৮৯-৯০)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর