জান্নাত মুমিনের চিরস্থায়ী ঠিকানা। যা অসংখ্য নেয়ামত দ্বারা সজ্জিত ও সুশোভিত। তবে ঈমান ও আমলের স্তরভেদে মুমিনরা জান্নাতের বিশেষ সুবিধা ও মর্যাদা লাভ করবেন। সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণ জান্নাতের স্তরের নাম ‘জান্নাতুল ফেরদাউস।’
এর উত্তরাধিকার স্বত্ব যারা পাবেন, তাদের বৈশিষ্ট্য ও বর্ণনা পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে—‘অবশ্যই মুমিনরা সফলকাম হয়েছে। যারা তাদের নামাজে বিনয়াবনত। যারা অনর্থক বিষয় থেকে বিরত থাকে। যারা জাকাত প্রদানে সক্রিয় থাকে। যারা লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। ...আর যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা নিজেদের নামাজে যত্নবান থাকে। তারাই উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা শীতল ছায়াময় জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী হবে। যাতে তারা হবে স্থায়ী অবস্থানকারী।’ (সুরা মুমিনুন: ১-১১)
বিজ্ঞাপন
উল্লেখিত আয়াতসমূহে এমন বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত হয়েছে, যা অর্জনে একজন মুমিন জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকার স্বত্ব লাভ করতে পারেন। নিম্নে এর সারসংক্ষেপ আলোচনা করা হলো।
নামাজে বিনয়াবনত
অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখা, অন্তরের প্রশান্তি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনসহ মুমিন বান্দার জন্য অসংখ্য কল্যাণ এবং সওয়াব রয়েছে নামাজে। তবে নামাজ হতে হবে একনিষ্ঠভাবে, বিনয়াবনত হয়ে ও যথাযথ নিয়ম মেনে। হজরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘এমন লোকও আছে, যারা নামাজ আদায় করা সত্ত্বেও নামাজের রুকন ও শর্তগুলো সঠিকভাবে আদায় না করায় এবং নামাজে পরিপূর্ণ একাগ্রতা ও খুশু-খুজু (একাগ্রতা) না থাকায় তারা নামাজের পরিপূর্ণ সওয়াব পায় না। বরং তারা দশ ভাগের এক ভাগ, নয় ভাগের এক ভাগ, আট ভাগের এক ভাগ, সাত ভাগের এক ভাগ, ছয় ভাগের এক ভাগ, পাঁচ ভাগের এক ভাগ, চার ভাগের এক ভাগ, তিন ভাগের এক ভাগ বা অর্ধাংশ সওয়াব প্রাপ্ত হয়।’ (সুনানে আবু দাউদ: ৭৯৬)
আরও পড়ুন: নামাজের পূর্ণ স্বাদ ও তৃপ্তি পেতে যা করবেন
অনর্থক কথা ও কাজ থেকে মুক্ত
যে কথা ও কাজে পার্থিব এবং পরকালীন কোনো কল্যাণ নেই, এমন বিষয়কে ‘অনর্থক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অনর্থক বিষয় পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহকে উসকে দেয় এবং অন্যের দোষ চর্চা ও গোনাহে লিপ্ত হতে বাধ্য করে। অনর্থক বিষয়ের অবতরণের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মসম্মান বিবর্জিত হয়। অনর্থক কার্মকাণ্ড ও বিষয় থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে আদর্শ মুসলিম এবং প্রকৃত মুমিনের সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা ফুটে ওঠে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘সুন্দর মুসলিম হওয়ার একটি নিদর্শন হলো অর্থহীন কাজ পরিত্যাগ করা।’ (জামে তিরমিজি: ২৩১৭)
বিজ্ঞাপন
জাকাত আদায়ে সচেষ্ট
জাকাত ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। কোরআন-হাদিসে অসংখ্য জায়গায় নামাজের পরপরই জাকাতের প্রসঙ্গ এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত দাও, রাসুলের আনুগত্য করো; যাতে তোমরা আল্লাহর রহমত পেতে পারো।’ (সুরা নুর: ৫৬)
তাছাড়া দারিদ্র্য বিমোচন, সুদমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ, সম্পদের পরিশুদ্ধকরণ, আত্মিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নসহ বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে জাকাতের সঠিক ও সুপরিল্পিত প্রয়োগে। জাকাতের বিধান লঙ্ঘন এবং জাকাত প্রদানে ঢিলেমি ও ছলচাতুরীর ব্যাপারে হুঁশিয়ারি এসেছে।
লজ্জাস্থানের হেফাজত
মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শারীরিক সুস্থতা মহান অল্লাহর অমূল্য দান। এগুলোর সামান্য ত্রুটিতে মানুষকে চরম বিপাকে পড়তে হয়। শারীরিক সুস্থতার যথাযথ মূল্যায়ন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে মুমিনকে সবসময় সচেতন ও সতর্ক থাকতে হয়। কেননা, পরকালে এ ব্যাপারে সে জিজ্ঞাসিত হবে। হাদিসে মানুষকে শরীরের দুটি অঙ্গ সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক করা হয়েছে। একটি মুখ, অন্যটি লজ্জাস্থান। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.)-কে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, ‘আল্লাহভীতি, সদাচার ও উত্তম চরিত্র।’ আবার তাকে প্রশ্ন করা হলো, কোন কাজ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, ‘মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (জামে তিরমিজি: ২০০৪)
আরও পড়ুন: যে কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ জান্নাতে যাবে
অঙ্গীকার পূরণ
বিশ্বস্ততা, আমানতদারিতা ও অঙ্গীকার পূরণ—এগুলো মানুষের উৎকৃষ্ট ও উন্নত গুণাবলীর অন্যতম। এগুলোর সঙ্গে মানুষের ঈমান-আমল ও দ্বীনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) এমন খুতবা খুব কম দিয়েছেন- যাতে এ কথা বলেননি যে, ‘যার আমানতদারি নেই, তার ঈমান নেই এবং যে অঙ্গীকার পূর্ণ করে না, তার মধ্যে দ্বীন নেই।’ (মুসনাদে আহমদ: ১২৬০৭)
নামাজে যত্নবান
সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ। যে ব্যক্তি নামাজে যত্নবান, তার জন্য ইসলামের অন্যান্য বিধান পালন সহজ হয়ে যায়। নামাজে অবহেলা খাঁটি মুমিনের জন্য শোভনীয় নয়। কোরআন-হাদিসে একাধিক স্থানে নামাজের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশনা এসেছে। সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহিন ও আইম্মায়ে মুজতাহিদিন প্রমুখদের জীবনে এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়। হজরত নাফে (রহ.) বর্ণিত, ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) তার শাসনামলে বিভিন্ন অঞ্চলের গভর্নরদের কাছে একটি জরুরি পত্র লেখেন যে, ‘আমার কাছে তোমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নামাজ। যে নামাজের হেফাজত করল এবং নামাজের প্রতি যত্নবান হলো সে ইসলামকে হেফাজত করল। আর যে নামাজকে নষ্ট করল, সে দ্বীনের অন্যান্য বিধান আরও বেশি নষ্টকারী হবে।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক: ০৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উক্ত গুণাবলী ধারণ করার তাওফিক দান করুন এবং আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে জান্নাতুল ফিরদাউসে অধিষ্টিত করুন। আমিন।