রোববার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

শবে বরাতে যেসব আমলকে বিদআত ভাববেন না

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫৩ পিএম

শেয়ার করুন:

শবে বরাতে যেসব আমলকে বিদআত বলা যাবে না

শাবান মাসের একটি মর্যাদাপূর্ণ রাতের নাম শবে বরাত। হাদিসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা ১৫ শাবানের রাত। ১৪ শাবান দিবাগত রাতই ১৫ শাবানের রাত। ‘শবে বরাত’ ফারসি শব্দ। ‘শব’ শব্দের অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ নাজাত বা মুক্তি। এই দুই শব্দ মিলে অর্থ হয় মুক্তির রজনী। 

একাধিক সহিহ হাদিসে এ রাতের মর্যাদা প্রমাণিত। তাছাড়া এ রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে বিশিষ্ট ইমামগণের নির্ভরযোগ্য বহু বক্তব্য। বিখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে অর্থাৎ শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে তাঁর সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫)


বিজ্ঞাপন


এই রাতে সওয়াবের আশায় যতখুশি ইবাদত বন্দেগি করা যাবে, কোরআন তেলোওয়াত, দোয়া, যত ইচ্ছা নামাজ, জিকির-আজকার, ইস্তেগফার, তাসবিহ-তাহলিলসহ সব করা যাবে। এসবের মধ্যে বিদআতের কিছু নেই। বরং এতে অনেক সওয়াব রয়েছে। তবে বিশেষ নিয়মে এবং দলবেঁধে ইবাদত সুন্নতের খেলাফ। তাই শবে বরাতে সুন্নাহ সমর্থিত নয়—এমন ইবাদত থেকে সাবধান থাকতে হবে। শবে বরাতে যেসব আমল বিদআতের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং সুন্নত—সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।

দীর্ঘ সেজদার নামাজ
শবে বরাতে নবীজির আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন—‘একবার রাসুলুল্লাহ (স.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো- তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? 

আমি উত্তরে বললাম, না- হে আল্লাহর রাসুল। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। তখন নবী (স.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত (শবে বরাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২-৩৮৩; তাবারানি: ১৯৪)

আরও পড়ুন: শবে বরাতে ৩টি কাজ ভুলেও করবেন না


বিজ্ঞাপন


দোয়া ও ইস্তেগফার
এই রাতে দোয়া ও ইস্তেগফার করা খুবই ফজিলতপূর্ণ আমল। ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘পাঁচটি রাত এমন রয়েছে, যে রাতের দোয়া ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।— ১. জুমার রাত। ২. রজব মাসের প্রথম রাত। ৩. শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত (শবে বরাত)। ৪. ঈদুল ফিতরের রাত। ৫. ঈদুল আজহার রাত।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজজাক: ৭৯২৭)

কোরআন তেলাওয়াত ও তাসবিহ তাহলিল
কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ তাহলিল ইত্যাদি আল্লাহর জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর জিকিরকারীরা এমনিতেই আল্লাহর প্রিয় বান্দা। ফজিলতপূর্ণ রাতে এর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল-সন্ধ্যা তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো।’ (সুরা আহজাব: ৪১-৪২) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর জিকির করে এবং যারা করে না, তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’(সহিহ বুখারি: ৬৪০৭) তাই যত বেশি সম্ভব শবে বরাতের রাতে কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি পড়া অনেক বড় সওয়াবের আমল।

কবর জিয়ারত
এই রাতে দলবদ্ধ ছাড়া একাকীভাবে কবর জিয়ারতে কোনো সমস্যা নেই। রাসুলুল্লাহ (স.) চুপিসারে একাকী জান্নাতুল বাকিতে কবর জিয়ারত করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন- ‘এক রাতে হজরত রাসুল (স.)-কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাঁকে দেখতে পেলাম। তিনি বললেন- কি ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার উপর কোন অবিচার করবেন? আয়েশা (র.) বললেন, আমার ধারণা হয়েছিল— আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসুলুল্লাহ (স.) তখন বললেন, যখন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাত আসে, তখন আল্লাহ তাআলা এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরির পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে তিরমিজি: ৭৩৯) 

আরও পড়ুন: কবর জিয়ারতের সময় ৫ বিষয় খেয়াল রাখবেন

আইয়ামে বিজের রোজা
‘শবে বরাত’ উপলক্ষে বিশেষ কোনো রোজা না থাকলেও কেউ চাইলে আইয়ামে বিজের রোজা রাখতে পারেন। প্রত্যেক মাসেই আইয়ামে বিজের রোজা রাখা ফজিলতপূর্ণ আমল। প্রতি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়ামে বিজ’ বলা হয়। আবু জর ও কাতাদা ইবনে মিলহান (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (স.) আইয়্যামে বিজ তথা শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে প্রতি মাসে এই তিন দিন রোজা রাখতে বলেছিলেন।’ (তিরমিজি: ৭৬১; নাসায়ি: ৪/২২৩-২২৪; ইবনে মাজাহ: ১৭০৭-১৭০৮; আবু দাউদ: ২৪৪৯) 

দান-সদকা
এই রাতে দরিদ্রদের সাহায্য, জাকাত ও দান-সদকা করা সুন্দর একটি আমল। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে বান্দাদের দান-সদকার জন্য উৎসাহিত করেছেন। এক আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে রিজিক দান করেছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেই দিন আসার আগে, যেদিন কোনো ক্রয়-বিক্রয় থাকবে না, কোনো বন্ধুত্ব কাজে আসবে না এবং সুপারিশও গ্রহণযোগ্য হবে না।’ (সুরা বাকারা: ২৫৪)

সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব রাখা
দোয়া কবুলের রাতেও মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষকারীরা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। তাই মন থেকে হিংসা দূর করে দিতে হবে। বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরি ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফেরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ (লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬)

আরও পড়ুন: হিংসা-বিদ্বেষ না থাকা জান্নাতিদের গুণ

শাবান মাসের নফল রোজা
মনে রাখতে হবে, পুরো শাবান মাসই ইবাদত-বন্দেগীতে কাটানোর মাস। রমজানের আগের মাস হওয়ায় অনেকে শাবানের প্রতি গুরুত্বারোপ করে না। এটি উচিত নয়। সবার মধ্যে শাবান মাসের গুরুত্ব তৈরি করতে রাসুল (স.) সর্বাধিক রোজা রাখতেন এই মাসে। নবীজি (স.) বলেন, রমজান ও রজবের মধ্যবর্তী এ মাসের ব্যাপারে মানুষ উদাসীন থাকে। এটা এমন মাস, যে মাসে বান্দার আমল আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। আমি চাই, আল্লাহর কাছে আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি রোজাদার। (সুনানে নাসায়ি: ২৩৫৭)

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী কারিম (স.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা অন্যকোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প ক’দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি: ৭৩৭)

বরকতের দোয়া
এছাড়াও রমজানের দুই মাস আগ থেকেই রাসুল (স.) একটি দোয়া বেশি বেশি পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সেই দোয়াটি আমরা পুরো রজব-শাবানে পড়তে পারি। শবে বরাতের রাতেও পড়া যাবে। দোয়াটি হলো— اَللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِىْ رَجَبَ وَ شَعْبَانَ وَ بَلِّغْنَا رَمَضَانَ (অর্থ) ‘হে আল্লাহ, আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’  আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রজব মাস শুরু হলে রাসুল (স.) এই দোয়া পাঠ করতেন। (বায়হাকি: ৩৫৩৪; নাসায়ি: ৬৫৯; মুসনাদে আহমদ: ২৩৪৬) 

শবে বরাতে যেসব কাজ করলে বিদআত হবে
শবে বরাতের বিশেষ নিয়মে কোনো আমলের কথা কোরআন-হাদিস ও সাহাবিদের জীবনীতে কোথাও নেই। কেউ বিশেষ পদ্ধতিতে নামাজ পড়ে, কেউ হালুয়া-রুটির আয়োজন করে, আবার কেউ কবর জিয়ারতকে ফরজ মনে করে—এসব নব-আবিষ্কৃত বিষয় থেকে  সতর্ক থাকতে হবে। শুধু শবে বরাতের রাতে না, বিদআত সবসময় বর্জনীয়। বিদআতের বিরুদ্ধে মহানবী (স.) অত্যন্ত কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম বাণী আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম আদর্শ মুহাম্মদের আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হলো, (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত বিষয়। (দ্বীনের মধ্যে) নব উদ্ভাবিত সব কিছুই বিদআত। প্রতিটি বিদআত ভ্রষ্টতা, আর প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিণাম জাহান্নাম।’ (সহিহ মুসলিম: ১৫৩৫; নাসায়ি: ১৫৬০)

সুতরাং আসুন, আমরা এ মাসকে গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করি, বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগি করি, রাসুল (স.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর