হাদিস শরিফে এমন তিনটি দামী আমলের কথা পাওয়া যায়, যেগুলো উম্মতকে সারাজীবন আঁকড়ে ধরার অসিয়ত করেছেন প্রিয়নবী (স.)। আমলগুলো হলো- ১. প্রতি মাসে তিন রোজা তথা আইয়ামে বিজের রোজা। ২. দুহার নামাজ (সূর্যোদয়ের পরের নফল নামাজ)। ৩. বিতির নামাজ।
এই তিন আমল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আমার প্রিয়তম (রাসুল স.) আমাকে তিনটি বিষয়ে অসিয়ত করেছেন, যেন আমি তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ত্যাগ না করি। প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা, দুহার নামাজ ও ঘুমানোর আগে বিতির আদায় করা।’ (সহিহ বুখারি: ১১৭৮)
বিজ্ঞাপন
এখানে লক্ষণীয় হলো—অসিয়ত সাধারণ কোনো কথা নয়, বরং জীবনের শেষদিকে মনের গভীর থেকে দেওয়া উপদেশ, যার বিশেষ গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য রয়েছে। পরম আপনজনকে মানুষ অসিয়ত করে। নবীজির প্রিয় সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-কে তিনি অসিয়ত করেছেন। এখন আমরা দেখব—উল্লেখিত তিনটি আমলের গুরুত্ব কী এবং কেন তিনি সারাজীবন সেগুলো পালন করতে বলেছেন।
১. প্রতিমাসে তিনদিন রোজা
প্রত্যেক চান্দ্রমাসে তিনদিন রোজা রাখা সুন্নত। এই রোজা রাখতে হয় প্রত্যেক আরবি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ। যেগুলোকে আইয়ামে বিজ বলা হয়। এ রোজাগুলোর গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বেশি। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘প্রতি মাসে তিনটি করে রোজা রাখা সারাবছর রোজা রাখার সমান।’ (বুখারি: ১১৫৯, ১৯৭৫)
রাসুলুল্লাহ (স.) নিয়মিত এই রোজা রাখতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (স.) বাড়িতে থাকাবস্থায় বা সফরে থাকাবস্থায় কখনোই আইয়ামে বিজের রোজা ছাড়তেন না। (নাসায়ি, রিয়াজুস সালেহিন: ১২৬৪)
আলেমরা এই রোজাগুলোর আরেকটি বিশেষ উপকারের কথা বলে থাকেন। সেটি হলো—এই রোজাগুলো মানুষকে আল্লাহর ইচ্ছায় কালো যাদু থেকেও রক্ষা করে। এছাড়াও নফল রোজা সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটি নফল রোজা রাখল, আল্লাহ তাআলা তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার ৫০ বছর রাস্তার দূরত্ব রাখবেন। (কানজুল উম্মাল: ২৪১৪৯)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: আইয়ামে বিজের রোজার ফজিলত
২. দুহার নামাজ
সূর্য মধ্য আকাশে স্থির হওয়ার আগে তথা সূর্যের উত্তাপে যখন বালি-মাটি গরম হতে থাকে তখন থেকে জোহরের ওয়াক্ত হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত দুহার নামাজ আদায় করতে হয়। হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, এই নামাজ দুই রাকাত, চার রাকাত বা আট রাকাত পড়া যায়। সাধারণ নফল নামাজের নিয়মে দুই রাকাত করে দুহা বা চাশতের নামাজ পড়বেন। এই নামাজের গুরুত্ব এতই বেশি যে, মানুষের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যে সদকা প্রতিদিন আদায় করতে হয় তা দুই রাকাত দুহার নামাজের মাধ্যমেই আদায় হয়ে যায়। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। মানুষের শরীরের অসংখ্য জোড়া রয়েছে। প্রত্যেকটি জোড়া বা জয়েন্টের আলাদা সদকা রয়েছে। এই সদকা আদায় না করলে আল্লাহর শুকরিয়ার হক আদায় হয় না। কিন্তু অনেকেই বিষয়টি না জানার কারণে এই ইবাদত থেকে গাফেল থাকে।
চাশতের নামাজ হচ্ছে এমনই এক নামাজ যার মাধ্যমে প্রত্যেক জোড়ার পক্ষ থেকে সদকা হয়ে যায়। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের শরীরে ৩৬০টি জোড়া আছে। অতএব, মানুষের কর্তব্য হলো প্রত্যেক জোড়ার জন্য একটি করে সদকা করা। সাহাবায়ে কেরাম বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কার শক্তি আছে এই কাজ করার?’ তিনি বলেন, ‘মসজিদে কোথাও থুতু দেখলে তা ঢেকে দাও অথবা রাস্তায় কোনো ক্ষতিকারক কিছু দেখলে সরিয়ে দাও। তবে এমন কিছু না পেলে, দুহার বা চাশতের দুই রাকাত নামাজ এর জন্য যথেষ্ট।’ (আবু দাউদ: ৫২২২)
হজরত আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (স.) এক যোদ্ধাবাহিনী প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধ সফরে তারা বহু যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভ করে খুব শীঘ্রই ফিরে আসে। লোকেরা তাদের যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটবর্তিতা, লব্ধ সম্পদের আধিক্য এবং ফিরে আসার শীঘ্রতা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। তা শুনে আল্লাহর রাসুল (স.) বললেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে ওদের চেয়ে নিকটতর যুদ্ধক্ষেত্র, ওদের চেয়ে অধিকতর লব্ধ সম্পদ এবং ওদের চেয়ে শীঘ্রতর ফিরে আসার কথার সন্ধান বলে দেব না? যে ব্যক্তি সকালে অজু করে চাশতের নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে যায় সে ব্যক্তি ওদের চেয়ে নিকটতর যুদ্ধক্ষেত্রে যোগদান করে, ওদের চেয়ে অধিকতর সম্পদ লাভ করে এবং ওদের চেয়ে অধিকতর শীঘ্র ঘরে ফিরে আসে।’ (আহমদ, তাবারানি, সহিহ তারগিব: ৬৬৩)
হজরত উকবা বিন আমের জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘হে আদম সন্তান! দিনের প্রথমাংশে তুমি আমার জন্য চার রাকআত নামাজ পড়তে অক্ষম হয়ো না, আমি তার প্রতিদানে তোমার দিনের শেষাংশের জন্য যথেষ্ট হবো।’ (আহমদ, আবু ইয়ালা, সহিহ তারগিব: ৬৬৬)
আরও পড়ুন: ইশরাক ও চাশতের নামাজ কখন পড়তে হয়, ফজিলত কী?
৩. বিতির নামাজ
পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নামাজ হলো বিতির। এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগপর্যন্ত বিতির নামাজ পড়ার সময়। তবে নিয়মিত শেষ রাতে ওঠার অভ্যাস আছে এমন ব্যক্তির জন্য রাতের শেষভাগে বিতির পড়া উত্তম। অবশ্য শেষরাতে ওঠার অভ্যাস না থাকলে ঘুমানোর আগেই বিতির পড়ে নেওয়া উচিত। রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি শেষ রাতে ওঠার ব্যাপারে নিশ্চিত নয়, সে যেন রাতের প্রথম ভাগে বিতির পড়ে নেয়। আর যে শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ পড়ার ব্যাপারে আশাবাদী, সে রাতের শেষ ভাগে বিতির পড়বে। কারণ, শেষ রাতের নামাজের সময় ব্যাপকহারে ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন এবং এটাই উত্তম।’ (সহিহ মুসলিম: ৭৫৫)
মহানবী (স.) কখনো বিতর ছাড়তেন না। সাহাবিদেরও বিতির পড়ার নির্দেশ দিতেন। খারেজা ইবনে হুজাফাতুল আদাভি থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (স.) আমাদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে একটি সালাত দ্বারা সাহায্য করেছেন, যা তোমাদের জন্য লাল উটের চেয়েও উত্তম, আর তা হচ্ছে বিতির, তিনি তা নির্ধারণ করেছেন এশা থেকে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত।’ (আবু দাউদ: ১৪১৮, তিরমিজি: ৪৫২)
হজরত আলী ইবনে তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বিতির পড়েছেন, অতঃপর বলেছেন, ‘হে আহলে কোরআন! তোমরা বিতির পড়, কারণ আল্লাহ বিতির (তথা বিজোড়), তিনি বিতির পছন্দ করেন।’ (তিরমিজি: ৪৫৩, আবু দাউদ: ১৪১৬)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে নবীজির অসিয়তকৃত উল্লেখিত গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো সারাজীবন আঁকড়ে ধরার তাওফিক দান করুন। আমিন।