২০২৪ সাল শেষ হতে অল্প সময় বাকি। নতুন বর্ষ তথা ২০২৫ সালে প্রবেশ করবে পৃথিবীবাসী। একজন মুমিনের জন্য নতুন বছর মানে শুধু ক্যালেন্ডার পরিবর্তন নয়, বরং নিজের ঈমান, আমল, আখলাক সমৃদ্ধ করার আরও একটি সুযোগ। নতুন বছরে মুমিন ফেলে আসা দিনগুলোর ভালো-মন্দ হিসাব করবে এবং আগামীর জন্য পরিকল্পনা করবে।
সাহাবায়ে কেরাম ও মুসলিম মনীষীরা গুরুত্বের সঙ্গে ফেলে আসা দিনগুলোর ভালো-মন্দ হিসাব করতেন এবং আগামীর জন্য প্রস্তুতি নিতেন। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলতেন, (আখেরাতে) তোমাদের হিসাব নেওয়ার আগে নিজেরা নিজেদের হিসাব করো। একইভাবে আমল পরিমাপের আগে নিজেরা একটু মেপে দেখো। কেননা আগামীদিনের হিসাব-নিকাশের আগে আজ নিজের হিসাব মিলিয়ে নেওয়া সহজ। (ইগাসাতুল লাহফান, পৃষ্ঠা-৯৪)
বিজ্ঞাপন
নতুন বছরে মুমিনের করণীয়
১. আত্মসমালোচনা করা
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান ওই ব্যক্তি, যে নিজের পর্যালোচনা করে এবং মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়। আর নির্বোধ ও অক্ষম সেই ব্যক্তি, যে মনোবৃত্তির অনুসরণ করে এবং অলীক কল্পনায় ডুবে থাকে।’ (তিরমিজি: ২৪৫৯)
২. তাওবা-ইস্তেগফার করা
অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে নেওয়ার জন্য তাওবা-ইস্তেগফারের চেয়ে ভালো কোনো পদ্ধতি নেই। তাই নতুন বছরে উচিত হবে- মহান আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করা। এটি মূলত জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘(ভালো মানুষ হচ্ছে তারা) যারা যখন কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেলে কিংবা নিজেদের ওপর নিজেরা জুলুম করে ফেলে, (সঙ্গে সঙ্গেই) তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং গুনাহের জন্যে (আল্লাহর কাছে) ক্ষমা প্রার্থনা করে। কেননা আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে গুনাহ মাফ করে দিতে পারে? (তদুপরি) এরা জেনে বুঝে নিজেদের গুনাহের ওপর কখনও অটল হয়ে বসে থাকে না। এই মানুষগুলোর প্রতিদান হবে, আল্লাহ তাআলা তাদের ক্ষমা করে দেবেন। আর (তাদের) এমন এক জান্নাত (দেবেন) যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা বইতে থাকবে, সেখানে (নেককার) লোকেরা অনন্তকাল অবস্থান করবে। সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জন্যে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) কত সুন্দর প্রতিদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।' (সুরা আল ইমরান: ১৩৫-১৩৬)
আরও পড়ুন: থার্টিফার্স্ট নাইট নিয়ে বায়তুল মোকাররম খতিবের সতর্ক বার্তা
৩. নেক আমলের পরিকল্পনা করা
পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজ সুন্দর হয় না। যেহেতু সংক্ষিপ্ত দুনিয়ার আমলের বিনিময়ে চিরস্থায়ী আখেরাতে প্রতিফল দেওয়া হবে, তাই মুমিনের উচিত হবে নিজের ঈমান-আমলকে সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং প্রত্যেকের উচিত আগামীর জন্য সে কী করেছে তা খতিয়ে দেখা..।’ (সুরা হাশর: ১৮)
বিজ্ঞাপন
কোরআন-হাদিস অধ্যয়ন, উপার্জনের একটি অংশ দান-সদকা করা, আল্লাহর রাস্তায় অংশগ্রহণ বাড়ানো, নফল ইবাদতের পরিমাণ বাড়ানো ইত্যাদি নেক আমলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে আগামীর দিনগুলো সে অনুযায়ী পরিচালনা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে আপনি তাদের সুসংবাদ দিন যে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতসমূহ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ...।’ (সুরা বাকারা: ২৪)
৪. কল্যাণকর ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করা
বছরের শুরুতে দোয়া করতে হবে যেন ভবিষ্যতের দিনগুলো সুন্দর ও কল্যাণকর হয়। আবদুল্লাহ ইবনে হিশাম বলেন- রাসুল (স.)-এর সাহাবিরা নতুন মাসের শুরুতে এই দোয়া পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন- اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ، وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلَامَةِ، وَالْإِسْلَامِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমানি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন।’ (আল-মুজাম আল-আওসাত: ০৬/২২১)
আরও পড়ুন: দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণে সর্বোত্তম দোয়া
দোয়াটি এভাবেও পড়া যায়— اللَّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ ، وَالإِيمَانِ ، وَالسَّلامَةِ ، وَالإِسْلامِ ، وَجَوَار مِنَ الشَّيْطَانِ، وَرِضْوَانٍ مِنَ الرَّحْمَنِ ‘আল্লাহুম্মা আদখিলহু আলাইনা বিল-আমনি, ওয়াল ইমানি, ওয়াস সালামাতি, ওয়াল ইসলামি, ওয়া ঝাওয়ারিম মিনাশ শায়ত্বানি, ওয়া রিদওয়ানিম মিনার রাহমান।’ অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের ঈমান ও ইসলামকে নিরাপদ করুন। আমাদের সুরক্ষা দিন। শয়তানের কুমন্ত্রণার মোকাবেলায় আমাদের সাহায্য করুন। দয়াময় রহমানের কল্যাণ দান করুন। (মু’জামুস সাহাবাহ: ০৩/৫৪৩; আল-ইসাবাহ: ০৬/৪০৭-৪০৮)
নতুন বছরে মুমিনের বর্জনীয়
নতুন বছর বা নওরোজকে পটকা ফুটিয়ে, ফানুস উড়িয়ে, হৈ-হুলোড় করে উদযাপন করতে হবে—এমন কিছু ইসলামে নেই। এসব অমুসলিমদের সংস্কৃতি। তাই মুসলমানরা এসব করতে পারে না। কেউ এসব কাজে যোগ দিলে হাদিসের ভাষ্যমতে তার পরিণতি ভালো হবে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি (কেয়ামতের দিন) তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আবুদাউদ, মেশকাত: ৪৩৪৭)
মনে রাখা জরুরি, ভালো কাজের জন্যও বিকট শব্দ করা ইসলামে অপছন্দনীয়। এতে রোগী, শিশু-বৃদ্ধদের কষ্ট হয়। ওমর (রা.)-এর যুগে জনৈক ব্যক্তি মসজিদে নববিতে এসে প্রতিদিন বিকট আওয়াজে ওয়াজ শুরু করতেন। এতে হুজরায় অবস্থানরত হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাজে ব্যাঘাত হত। তাই তিনি ওমর (রা.)-কে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি ওই লোককে নিষেধ করে দেন। লোকটি কিছুদিন পর আবার ওয়াজ শুরু করলে তিনি তাকে শাস্তি দেন। (আখবারু মদিনা, ওমর ইবনে শাব্বাহ: ১/১৫)
এছাড়াও যেকোনো অনর্থক কাজ থেকে মুসলিমদের বিরত থাকতে হবে। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হলো অনর্থক বিষয় ত্যাগ করা।’ (তিরমিজি: ২৩১৮) রাসুলুল্লাহ (স.) আরও বলেছেন, ‘দুনিয়াতে তুমি পরদেশি কিংবা পথিকের মতো থাকো এবং নিজেকে কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য করো। (অর্থাৎ তোমাকে যে নিশ্চিত কবরে যেতে হবে, সেটা মনে রাখ।) (জামে তিরমিজি: ২৩৩৩)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সকল অপসংস্কৃতি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর দিনগুলো যেন কল্যাণময় হয় সেদিকে মনোযোগী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

