পর্দা ফারসি শব্দ। আরবি প্রতিশব্দ ‘হিজাব’। পর্দা বা হিজাবের বাংলা অর্থ আবৃত করা, ঢেকে রাখা, আবরণ, গোপন করা ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায়, নারী-পুরুষ উভয়ের চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জনের নিমিত্তে উভয়ের মধ্যে ইসলাম কর্তৃক নির্ধারিত যে আড়াল বা আবরণ রয়েছে তাকে পর্দা বলা হয়।
পর্দা ইসলামের অপরিহার্য বিধান। কোরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি বিধানের মতোই এটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা প্রাপ্তবয়স্ক তিন শ্রেণির নারীর ওপর পর্দা ফরজ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
তারা হলেন- ১. নবীপত্নী ২. নবীকন্যা ৩. মুমিন নারী। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব: ৫৯)
এই তিন শ্রেণির মধ্যে আপনি না পড়লে আপনার জন্য পর্দা ফরজ নয়। মুমিন নারী হয়ে যারা পর্দার বিধান মেনে চলে না, তাদের ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নারী পর্দাবৃত থাকার বস্তু। যখন সে পর্দাহীন হয়ে বের হয়, তখন শয়তান তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। (তিরমিজি: ১১৭৩) অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট তারাই, যারা পর্দাহীনভাবে চলাফেরা করে।’ (বায়হাকি: ১৩২৫৬)
আরও পড়ুন: স্বামীর সামনে সতর খুলে রাখা জায়েজ?
চার শর্ত মেনে পর্দা করা জরুরি। ১. বোরকা বা অন্যকোনো পন্থায় গোটা শরীর ঢেকে রাখা। ২. পরিহিত বোরকা ফ্যাশনমূলক না হওয়া। ৩. বোরকার কাপড় মোটা হওয়া, যাতে শরীরের আকৃতি অনুধাবন করা না যায়। ৪. বোরকা ঢিলেঢালা হওয়া। (আবু দাউদ: ২/৫৬৭, মুসলিম: ২/২০৫, আহসানুল ফতোয়া: ৮/২৮, তিরমিজি: ২/১০৭)
বিজ্ঞাপন
ঘরে ও বৃদ্ধাবস্থায় পর্দা পালনে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। ঘরে কিভাবে পর্দা করতে হবে তার নির্দেশনা আল্লাহ তাআলা বলেন—‘যখন তোমরা তাদের (নবীপত্নীদের) কাছে কিছু চাইবে, পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ বিধান তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতার কারণ।’ (সুরা আহজাব: ৫৩) এ আয়াতে নবীপত্নীদের কথা থাকলেও এ বিধান সবার জন্য প্রযোজ্য। এ বিধানের সারমর্ম—নারীদের কাছ থেকে ভিন্ন পুরুষদের কোনো ব্যাবহারিক বস্তু, পাত্র, বস্ত্র ইত্যাদি নেওয়া জরুরি হলে সামনে এসে নেবে না, বরং পর্দার আড়াল থেকে চেয়ে নেবে।
বাইরের পর্দা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলছেন—‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী, কন্যা এবং মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন (প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সময়) তাদের (পরিহিত) জিলবাবের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে; ফলে তাদের উত্ত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব: ৫৯) জিলবাব হলো নারীর এমন পোশাক, যা দিয়ে তারা পুরো দেহ ঢেকে রাখে। আমাদের দেশে যা বোরকা নামে পরিচিত। যদিও বোরকা পড়তে হবে কথা নেই, মূলত যে পোশাকের মাধ্যমে আপাদমস্তক আবৃত করা সহজ হয়। আয়াতে জিলবাবের একাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে নেওয়া। যা সাহাবি, তাবেঈ ও নির্ভরযোগ্য মুফাসসিরদের তাফসির থেকে প্রমাণিত।
আরও পড়ুন: নারীর চেহারা কি পর্দার অংশ?
বৃদ্ধ অবস্থায় পর্দা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতিশয় বৃদ্ধ নারী, যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্য অপরাধ নেই, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের অতিরিক্ত বস্ত্র খুলে রাখে। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর: ৬০) আয়াতের নির্দেশনা হলো- বৃদ্ধা নারীর প্রতি কেউ আকর্ষণ বোধ করে না এবং সে বিবাহেরও যোগ্য নয় তার জন্য পর্দার বিধান শিথিল করা হয়েছে। গায়রে মাহরাম ব্যক্তিও তার কাছে মাহরামের মতো হয়ে যায়। মাহরামদের কাছে যেসব অঙ্গ আবৃত করা জরুরি নয়, বৃদ্ধা নারীদের জন্য গায়রে মাহরাম পুরুষদের কাছেও সেগুলো আবৃত করা জরুরি নয়। এরূপ বৃদ্ধা নারীর জন্য বলা হয়েছে, মাহরাম পুরুষদের সামনে যেসব অঙ্গ খুলতে পারবে, গায়রে মাহরাম পুরুষদের সামনেও সেগুলো খুলতে পারবে। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন: খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা-৪৩৯)
উল্লেখ্য, মাহরামদের সামনে নারীদের সতর হলো মাথা, চুল, গর্দান, কান, হাত, পা, টাখনু, চেহারা, গর্দানসংশ্লিষ্ট সিনার ওপরের অংশ ছাড়া বাকি পূর্ণ শরীর। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ৫/৩২) নামাজের সময় হাত, পা, মুখ ছাড়া পূর্ণ শরীরই সতর। অন্য সময় গায়রে মাহরামের সামনে নারীর পূর্ণ শরীরই সতর। তবে অতীব প্রয়োজনে চেহারা, পা ও হাত খোলা জায়েজ আছে। যেমন—রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় হলে, আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া ইত্যাদি। (ফতোয়ায়ে শামি: ১/৪০৬, ফতোয়ায়ে রহিমিয়া: ৪/১০৬) স্বামীর জন্য তার স্ত্রীর কোনো সতর নেই। তেমনি স্ত্রীর জন্য স্বামীর কোনো সতর নেই, সব দেখতে পারবে। তবে গোপনাঙ্গ না দেখার বিষয়ে হাদিসে নির্দেশনা এসেছে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী গোপনাঙ্গ না দেখা উত্তম।
আর পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। অর্থাৎ এতটুকু স্থান অন্য ব্যক্তিদের সামনে ঢেকে রাখা ফরজ। বাকি মানুষের সামনে যাওয়ার সময় ক্ষেত্র ও সমাজ হিসেবে যা শালীন ও খোদাভীতি প্রকাশ করে এমন পোশাক পরিধান করা উত্তম।

