আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া অনেক দামি একটি ইবাদত। আল্লাহ তাআলা যখন তাঁর কোনো বান্দাকে নেয়ামত দান করেন, তখন বান্দার দায়িত্ব হলো, প্রাপ্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব; আর আমার শুকরিয়া আদায় করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা: ১৫২)
রাসুলুল্লাহ (স.) একদিন প্রিয় সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-কে হাত ধরে বললেন, ‘মুয়াজ! আল্লাহর কসম আমি তোমাকে ভালোবাসি’। লক্ষ্য করুন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সত্যবাদী মানুষটি আল্লাহর কসম করে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করছেন! তা-ও প্রিয় সাহাবিকে! তখন মুয়াজ (রা.) বললেন, ‘আমার মা-বাবা আপনার জন্য কোরবান হোক, আমিও আল্লাহর কসম, আপনাকে ভালোবাসি’। এভাবে ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘মুয়াজ! আমি তোমাকে বলছি, কখনও নামাজের পরে এ দোয়াটি পড়তে ভুল করো না- اللّهُمَّ أَعِنِّيْ عَلٰى ذِكْرِكَ وَشُكْرِكَ وَحُسْنِ عِبَادَتِكَ ‘হে আল্লাহ! আপনার জিকির, আপনার কৃতজ্ঞতা ও শোকর আদায় এবং সুন্দর করে আপনার ইবাদত করতে আপনি আমাকে সাহায্য করুন।’ (মুসনাদে আহমদ: ২২১১৯; আবু দাউদ: ১৫২৪)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: মুমিনদের জন্যে আল্লাহর ২৫ প্রতিশ্রুতি
হাদিসে ঘোষণা করা হচ্ছে, আল্লাহর জিকির ও সুন্দর ইবাদতের মতোই অনেক মূল্যবান একটি আমল আল্লাহর শুকরিয়া আদায়। একজন প্রকৃত মুমিনকে এই আমলের মর্যাদা বুঝতে হয়। মুমিনকে উপলব্ধি করতে হয় যে মহান আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতে ডুবে আছে মানুষ। মহামূল্যবান জীবন, মেধা, জ্ঞান-বুদ্ধি, নাক, কান, চোখ, মুখ, জিহ্বা, হাত-পা, আলো, বাতাস, পানি, বসবাসের উপযুক্ত পৃথিবী না চাইতেই তিনি বান্দাদের দান করেছেন। সুখ-শান্তি, প্রয়োজনীয় রিজিক, সম্পদসহ অসংখ্য নেয়ামত তিনি ক্ষণে ক্ষণে বিলিয়ে যাচ্ছেন। তাই প্রতিনিয়ত মুমিনের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হওয়া উচিত ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, সবই আল্লাহর দান’।
নবী ঈসা (আ.)-কে আল্লাহ তাআলা বলেছিলেন, ‘তোমার পরবর্তীতে আমি এক উম্মত পাঠাব, কাঙ্ক্ষিত কোনো বিষয় যদি তাদের হাসিল হয় তাহলে তারা আল্লাহর প্রশংসা করবে এবং শুকরিয়া আদায় করবে, আর যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কিছু তাদের পেয়ে বসে তাহলে তারা সওয়াবের আশায় ধৈর্যধারণ করবে। (মুসনাদে আহমদ: ২৭৫৪৫; মুসতাদরাকে হাকেম: ১২৮৯; শুয়াবুল ঈমান, বায়হাকি: ৪১৬৫; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১৬৭০৪)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, মুমিনের বিষয়াদি কত আশ্চর্যের! তার সবকিছুই কল্যাণকর। আর এটা তো কেবল মুমিনের ক্ষেত্রেই হতে পারে। সচ্ছলতায় সে শুকরিয়া আদায় করে, তখন তা তার জন্যে কল্যাণকর হয়। আর যদি তার ওপর কোনো বিপদ নেমে আসে তাহলে সে সবর করে, ফলে তাও তার জন্যে কল্যাণকর হয়ে যায়। (সহিহ মুসলিম: ২৯৯৯)
বিজ্ঞাপন
আল্লাহর শুকরিয়ার বিশেষ কিছু প্রতিদান ঘোষণা করা হয়েছে কোরআন-হাদিসে। শুকরিয়া আদায়কারীদেরকে শুধু নেয়ামতের ওপরই রাখা হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো, তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের (নেয়ামত) বাড়িয়ে দেবো, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয়ই আমার আজাব বড় কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম: ০৭)
আরও পড়ুন: কোরআন-হাদিসের আলোকে সুখী হওয়ার ১৫ উপায়
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল নিজ কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর যে অকৃতজ্ঞ হয়, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’ (সুরা লোকমান: ১২)
সেজন্যই প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো- আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সবসময় আলহামদুলিল্লাহ বলা। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ সেই বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন, যে বান্দা কিছু খেলে আল্লাহর প্রশংসা করে এবং কিছু পান করলেও আল্লাহর প্রশংসা করে (অর্থাৎ আলহামদুলিল্লাহ) পড়ে।’ (মুসলিম: ২৭৩৪, তিরমিজি: ১৮১৬)
এভাবেই সবকিছুতেই আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে মুমিনদের। ‘অতএব, আল্লাহ তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র বস্তু দিয়েছেন, তা তোমরা আহার করো এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো যদি তোমরা তাঁরই ইবাদতকারী হয়ে থাকো।’ (সুরা নাহল: ১১৪)
এমনকি প্রিয়বস্তু হারানোর পরও আলহামদুলিল্লাহ বলতে উৎসাহিত করা হয়েছে মুমিনদের। এ ধরণের বান্দার জন্য জান্নাতে বিশেষ নেয়ামতের ঘোষণা দিয়ে মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যখন কোনো বান্দার সন্তান মারা যায়, তখন মহান আল্লাহ (জান কবজকারী) ফেরেশতাদের বলেন, ‘তোমরা আমার বান্দার সন্তানের প্রাণ হরণ করেছ কি? তারা বলেন, হ্যাঁ। তিনি বলেন, তোমরা তার হৃদয়ের ফলকে হনন করেছ? তারা বলেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বলেন, ‘সেসময় আমার বান্দা কী বলেছে?’ তারা বলেন, ‘সে আপনার হামদ (প্রশংসা) করেছে ও ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রা-জিউন পাঠ করেছে।’ মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার (সন্তানহারা) বান্দার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ করো, আর তার নাম রাখো ‘বায়তুল হামদ’ (প্রশংসাভবন)।’ (তিরমিজি: ১০২১)
আরও পড়ুন: অসুখ-বিসুখ নেককার বান্দার জন্য বিশেষ নেয়ামত
অসুস্থ ব্যক্তির আলহামদুলিল্লাহ বলা সম্পর্কে হাদিসে কুদসিতে এসেছে- মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমি আমার মুমিন বান্দাকে রোগাক্রান্ত করি, আর বান্দা সে অবস্থায় আমার প্রশংসা করে আলহামদুলিল্লাহ বলে; তবে সে বিছানা থেকে এমনভাবে ওঠে দাঁড়ায়; যেন তার মা তাকে ভূমিষ্ঠকালে যেমন জন্মদান করেছিল।’ (হাদিসে কুদসি)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সুসময়ে-দুঃসময়ে বেশি বেশি আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করার তাওফিক দান করুন। যেকোনো নেয়ামতে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।