মুমিন আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে মনে-প্রাণে শক্তি সঞ্চয় করেন। কারণ জিকির হলো ইবাদতের রুহ ও প্রাণ। আল্লাহর জিকির দুনিয়া-আখেরাতে সফলতার উপায়। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে যাতে সফলতা অর্জন করো।’ (সুরা আনফাল: ৪৫)
আল্লাহ তাআলার জিকির এমন এক মজবুত রজ্জু যা বান্দাকে তার প্রতিপালকের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেয়, গুনাহ থেকে রক্ষা করে এবং তাঁর সান্নিধ্য লাভের পথ সুগম করে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা ইমানদারদের দিনে-রাতে গোপনে-প্রকাশ্যে বেশি বেশি জিকির করার আদেশ দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করো এবং সকাল-সন্ধ্যা তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো।’ (সুরা আহজাব: ৪১-৪২)
বিজ্ঞাপন
পবিত্র কোরআনে জিকিরবিমুখ ব্যক্তি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত। আর তাকে কেয়ামতের দিন উঠাব অন্ধ করে।’ (সুরা ত্বহা: ১২৪) রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যারা আল্লাহর জিকির করে এবং যারা করে না, তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’(সহিহ বুখারি: ৬৪০৭)
অতএব মুমিন ব্যক্তির শক্তি সঞ্চয়ের সর্বোত্তম উপায় হলো আল্লাহর জিকির। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা শরিয়ত অনুমোদিত প্রত্যেক আমলই জিকির হিসেবে বিবেচিত। কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন সবকিছুই জিকির। একইভাবে তাসবিহ, তাহলিল, তাহমিদ, তাকবির, ইস্তেগফার ইত্যাদিও আল্লাহর জিকিরের অন্তর্ভুক্ত। নিচে বিস্ময়কর ফজিলতপূর্ণ ৬টি জিকির তুলে ধরা হলো, যেসব জিকির আপনাকে শক্তি যোগাবে; হায়াতে তাইয়েবা লাভের বড় উপায় হবে।
১. ইস্তেগফার
ইস্তেগফারে বড় প্রাপ্তি হলো এতে গুনাহ মাফ হয়। এছাড়াও এর কিছু বিস্ময়কর উপকার রয়েছে। যেমন—বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর হওয়া, রিজিক ও সন্তান-সন্ততিতে বরকত আসা। মুমিনের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার পেছনে ইস্তেগফারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল। (ক্ষমাপ্রার্থনা করলে) তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদেরকে তিনি ধনসম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন। তোমাদের জন্যে তিনি বিভিন্ন রকমের বাগান ও অনেক নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন। (সুরা নুহ: ১০-১২)
হাদিসেও একই কথা এসেছে। ‘যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (মুস্তাদরাকে হাকেম: ৭৬৭৭)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: ইস্তেগফার কীভাবে করতে হয়?
২. দরুদ
আল্লাহ তাআলা দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর ওপর দরুদ পাঠান, হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরাও নবীর ওপর দরুদ পাঠাতে থাকো এবং উত্তম অভিবাদন (সালাম) পেশ করো।’ (সুরা আহজাব: ৫৬)
আল্লাহ তাআলার এই নির্দেশ একদিকে যেমন আল্লাহর কাছে তাঁর রাসুলের মর্যাদার প্রমাণ অন্যদিকে মুমিন বান্দার রহমত, বরকত ও অবারিত কল্যাণ লাভের অন্যতম উপায়। একজন মুমিনের সকল মাকসুদ লাভ হয় দরুদে। উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) আল্লাহর জিকিরের খুব তাকিদ করলেন। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে থাকি। আমি আমার দোয়ার কতভাগ আপনার জন্য নির্ধারণ করব? তিনি বললেন, তোমার যে পরিমাণ ইচ্ছা। আমি বললাম, চারভাগের এক ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে তিন ভাগের দুই ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা হয়। তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে কি আমার দোয়ার পুরোটাই হবে আপনার প্রতি দরূদ? তিনি বললেন, তবে তো তোমার মকসুদ হাসিল হবে, তোমার গুনাহ মাফ করা হবে।’ (তিরমিজি: ২/৭২; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১০/২৪৮; মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৬/৪৫)
৩. বিশেষ চার তাসবিহ
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ১০০ বার করে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবর’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়বে, সেদিন তার চেয়ে বেশি সওয়াব কেউ আল্লাহর দরবারে পাঠাতে পারবে না। ওই ব্যক্তি ছাড়া যে তার মতো ওই জিকিরগুলো করেছে। উম্মুহানি (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি বুড়ো ও দুর্বল হয়ে গেছি। আমাকে এমন একটি আমল শিখিয়ে দিন, যা আমি বসে বসে পালন করতে পারব। তিনি বললেন, তুমি ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে, তাহলে ১০০টি ক্রীতদাস মুক্ত করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। ১০০ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে, তাহলে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের জন্য ১০০টি সাজানো ঘোড়ায় মুজাহিদ পাঠানোর সমপরিমাণ সওয়াব তুমি পাবে। ১০০ বার ‘আল্লাহু আকবর’ বলবে, তাহলে ১০০টি মাকবুল উট কোরবানির সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তুমি ১০০ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, তাহলে তোমার সওয়াবে আসমান ও জমিন পূর্ণ হয়ে যাবে (এবং তোমার কোনো পাপই বাকি থাকবে না: দ্বিতীয় বর্ণনায়)। যে ব্যক্তি তোমার এ জিকিরগুলোর সমপরিমাণ জিকির করবে, সে ছাড়া কেউই সে দিনে তোমার চেয়ে বেশি বা উত্তম আমল আল্লাহর দরবারে পাঠাতে পারবে না।’ (ইবনে মাজাহ: ২/১২৫২; মুসনাদে আহমদ: ৬/৩৪৪; নাসায়ি, আস-সুনানুল কুবরা: ৬/২১১; তাবারানি, আল মুজামুল কাবির: ২৪/৪১০; মুসতাদরাক হাকিম: ১/৬৯৫)
আরও পড়ুন: চার তাসবিহ ১০০ বার করে পড়ার বিস্ময়কর ফজিলত
৪. বিশেষ তাসবিহ
হাদিসে একটি জিকিরের বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জিকিরটি হলো—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আ'লা কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার উক্ত কালেমাটি বলবে, সে ১০টি গোলাম আজাদ করার সমান সওয়াব লাভ করবে, তার নামে ১০০টি সওয়াব লেখা হবে ও তার আমলনামা হতে ১০০ গুনাহ মুছে ফেলা হবে। আর সে সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তানের ধোঁকা থেকে মুক্ত থাকবে। কেয়ামতের দিন কেউ তার থেকে ভালো আমল আনতে পারবে না, একমাত্র সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে তার থেকে বেশি নেক আমল করেছে।’ (সহিহ বুখারি: ৬০৪০)
৫. দোয়া ইউনুস
দোয়া ইউনুস-এর ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশি। যে কোনো বিপদ-মসিবত, দুশ্চিন্তা-পেরেশানি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে দোয়া ইউনুস পাঠ করা অত্যন্ত কার্যকর আমল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তখন আমি তার (ইউনুসের) ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮৮) দোয়া ইউনুস হলো— لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ‘লা ইলা-হা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বলিমিন।’ অর্থ: ‘তুমি ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই; তুমি পুতঃপবিত্র, নিশ্চয় আমি জালিমদের দলভুক্ত।’
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমি তোমাদের এমন বিষয়ের সংবাদ দেবো যে তোমাদের কারো ওপর যখন দুনিয়াবি কোনো কষ্ট-ক্লেশ অথবা বালা-মসিবত নাজিল হয়, তখন তার মাধ্যমে দোয়া করলে তা দূরীভূত হয়। তা হলো ইউনুস (আ.)-এর দোয়া—‘লা ইলা-হা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বলেমিন।’ (সহিহুল জামে: ২৬০৫)
বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে, দৈনিক এক হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লে পদমর্যাদা সমুন্নত হয়। আল্লাহ তার রুজি-রোজগারে সমৃদ্ধি দান করেন। দুঃখ-যন্ত্রণা, পেরেশানি, অশান্তি ও কষ্ট-প্রভৃতি দূর করেন। তার জন্য সবরকম কল্যাণের দ্বার খুলে দেন। শয়তানের প্ররোচনা থেকে তাকে রক্ষা করেন। এক লাখ পঁচিশ হাজার বার পড়লে (যেটা খতমে ইউনুস হিসেবে পরিচিত) সব ধরনের অপকার থেকে রক্ষা, বিপদ-আপদ থেকে দূরে থাকা এবং রোগ-শোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে।
আরও পড়ুন: বিপদ থেকে বাঁচার ছয়টি কার্যকরী দোয়া
৬. আল্লাহর গুণবাচক নামের জিকির
আল্লাহর গুণবাচক নামের জিকির করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে কোরআন ও হাদিসে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেইসব নামেই ডাকবে..।’ (সুরা আরাফ: ১৮০) এর বিস্ময়কর উপকার রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলার নিরানব্বই নাম আছে, এক কম একশত নাম। যে ব্যক্তি এ (নাম) গুলোর হেফাজত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ বিজোড়; তিনি বিজোড় পছন্দ করেন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪১০)
এখানে উল্লেখ্য, মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হলো ذُو الْجَلَالِ وَالْاِكْرَامِ ‘জুল জালালি ওয়াল ইকরাম’। এই নামের দুটি অংশ। প্রথম অংশ ‘জুল জালাল’ অর্থ হলো- ‘সমস্ত সৃষ্টিজগতের অধিপতি; যিনি সৃষ্টিকুল থেকে ভয় পাওয়ার হকদার ও একমাত্র প্রশংসার যোগ্য; দ্বিতীয় অংশ ‘আল-ইকরাম’ অর্থ হলো- মহত্ব-বড়ত্ব-দয়া ও ইহসানের অধিকারী’। প্রথম অংশ ও দ্বিতীয় অংশ একসঙ্গে পড়লে হয় জুল জালালি ওয়াল ইকরাম। যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে শেষ করার জন্য, কাজের ভালো ফলাফলের জন্য এবং দুনিয়ার ধন-দৌলত ও রিজিকের প্রশস্ততার জন্য এই জিকির বেশি বেশি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। কেননা এই জিকিরের মাধ্যমে একসঙ্গে দুটি কাজ হয়। ১. মহামহিম আল্লাহর উচ্চমর্যাদার গুণকীর্তন ২. দয়াবান আল্লাহর দয়ার ভিখারি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন। তাছাড়া নবী কারিম (স.) এই জিকিরকে সর্বদা আঁকড়ে ধরতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম-কে সর্বদা আঁকড়ে ধরে থাকবে।’ (তিরমিজি: ৫/৫০৪; মুসতাদরাক হাকিম: ১/৬৭৬)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উল্লেখিত জিকিরগুলো নিয়মিত পড়ার তাওফিক দান করুন। এসব জিকিরের হেফাজতকারীকে দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্য দান করুন। আমিন।