অনলাইনে কোনো ভিডিও, ছবি বা লেখা প্রচণ্ড গতিতে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণত সেটাকেই আমরা ভাইরাল বলি। কিছু ভাইরাল বিষয় স্রেফ আনন্দ দিয়ে যায়, কোনোটি ভাবায় কিংবা কাঁদায়। কোনোটি সমাজে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। অনেকেই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে উদগ্রীব। কিন্তু আমরা কি জানি, ভাইরাল হওয়া বা করা যখন নেশায় পরিণত হয়, তখন অনেক বড় বড় পাপ সংঘটিত হতে পারে। এখানে আমরা দেখে নেব, ভাইরালের অসুস্থ মানসিকতার কারণে কী কী পাপ সংঘটিত হওয়ার আশংকা থাকে।
১. অশ্লীলতার প্রসার
ভাইরালের নেশা থেকে অনেকেই অশালীন বিষয় প্রচার করতে দ্বিধা করে না। অথচ তা কবিরা গুনাহ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘স্মরণ রেখো, যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীল বিষয়ের প্রসার হোক- এটা কামনা করে, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা নুর: ১৯)
বিজ্ঞাপন
২. মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় অনুমতি ছাড়া প্রচার
ভাইরালের নেশা থেকে মানুষ অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় অনুমতি ছাড়া প্রচার করে। যা তার মনোকষ্টের কারণ হয়। অনেক ক্ষেত্রে তার জীবনও বিপন্ন হয়ে যায়। অথচ একজন মুমিনের জন্য অন্য মুমিনের ইজ্জত রক্ষা করা জরুরি। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় প্রচার করা তো দূরের কথা, কারো ব্যক্তিগত গোপন বিষয় ও দোষ খোঁজাও ইসলামে নিন্দনীয়। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের কথা গুপ্তভাবে শুনল; অথচ সে তাদের কথাগুলো শুনুক তারা তা পছন্দ করছে না অথবা তারা তার অবস্থান টের পেয়ে তার থেকে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে, কেয়ামতের দিন এজন্য তার কানে সিসা ঢেলে দেওয়া হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৭০৪২)
আরও পড়ুন: অন্যের সম্মান রক্ষা করলে আল্লাহ আপনাকে যেভাবে সম্মানিত করবেন
৩. মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ
মানুষকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা খুবই ঘৃণিত বিষয়। ভাইরালের নেশা থেকে একে অন্যকে হাসির পাত্রে পরিণত করে। এটি মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। বরং তা ইহুদি ও মুশরিকদের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে— ‘যারা অপরাধী, তারা বিশ্বাসীদের উপহাস করত এবং তারা যখন তাদের কাছ দিয়ে গমন করত তখন পরস্পরে চোখ টিপে ইশারা করত।’ (সুরা মুতাফফিফিন: ২৯-৩০) ‘তারা যখন তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরত, তখনও হাসাহাসি করে ফিরত। আর যখন তারা বিশ্বাসীদেরকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয় এরা বিভ্রান্ত। অথচ তারা বিশ্বাসীদের তত্ত্বাবধায়করূপে প্রেরিত হয়নি।’ (সুরা মুতাফফিফিন: ৩১-৩৩)
আল্লাহতায়ালা অন্যত্র ইরশাদ করেন, কিছু মানুষ এমন, যারা অজ্ঞতাবশত আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করার জন্য এমন সব ‘অবান্তর কথা’ ক্রয় করে, যা আল্লাহ সম্পর্কে উদাসীন করে দেয় এবং তারা আল্লাহর পথ নিয়ে ঠাট্টাবিদ্রূপ করে। তাদের জন্য আছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি। (সুরা লুকমান: ০৬)
বিজ্ঞাপন
ঠাট্টা-বিদ্রূপ এতটাই নিকৃষ্ট কাজ যে মহানবী (স.) একে ‘দূষণ সৃষ্টিকারী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনো এক সময় মহানবী (স.)-কে আমি জনৈক ব্যক্তির চালচলন নকল করে দেখালাম। তিনি বলেন, আমাকে এই পরিমাণ সম্পদ প্রদান করা হলেও কারো চালচলন নকল করা আমাকে আনন্দ দেয় না। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (স.)! সাফিয়্যা তো বামন নারী লোক, এই বলে তিনি তা হাতের ইশারায় দেখালেন। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, তুমি এমন একটি কথার দ্বারা বিদ্রূপ করেছ, তা সাগরের পানির সঙ্গে মেশালেও ওই পানিকে দূষিত করে ফেলত। (তিরমিজি: ২৫০২)
আরও পড়ুন: হাদিসে মন্দ লোক চেনার সহজ সূত্র
৪. অহংকার
ভাইরালের নেশা কিছু মানুষকে অহংকারী বানিয়ে দেয়। বিশেষ করে ভাইরাল বিষয়গুলো থেকে যখন উপার্জন শুরু হয়, কিংবা তার একটা অবস্থান তৈরি হয়, তখন তার অহংকারের সীমা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে হেয় করতেও দ্বিধা করে না। এরকম অনেক উদাহরণ আপনার চারপাশে চোখ বুলালেই দেখতে পাবেন। অথচ অহংকারের পরিণতি ভয়াবহ। কেয়ামতের দিন তাদের ‘বলা হবে- জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করো, তোমাদেরকে চিরকাল এখানে থাকতে হবে। অহংকারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট!’ (সুরা জুমার: ৭২)
৫. যাচাই-বাছাই ছাড়া খবর প্রকাশ
ইসলামে মিথ্যা খবর প্রকাশ করা জায়েজ নেই। কিন্তু যারা ভাইরালের নেশায় মত্ত, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাছবিচার ছাড়াই খবর প্রকাশ করে থাকে। যা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কোনো লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (যাচাই না করে) তাই বলে বেড়ায়’। (সহিহ মুসলিম: ৫)
৬. হারাম উপার্জনের আশংকা
ভাইরাল আসক্তির কারণে হালাল-হারামের বোধশক্তি অনেকাংশে লোপ পায়। যার কারণে অনেকে দেখবেন, হারাম বিষয়গুলো ভাইরাল করার চেষ্টা করে, যা থেকে এক পর্যায়ে প্রচুর উপার্জনও করে থাকে। একবারও চিন্তা করে না যে, হারাম উপার্জনকারীর কোনো ইবাদতই কবুল হয় না। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো সালাত কবুল করেন না এবং অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সদকা গ্রহণ করেন না।’ (নাসায়ি: ১৩৯)
আরও পড়ুন: হারাম উপার্জনের পরিণতি
৭. অযথা সময় নষ্ট করা
মুমিনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। ভাইরালের নেশায় যারা মত্ত, তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরকালের ব্যাপারে হুঁশ থাকে না। অথচ দুনিয়ার ছোট্ট সময়ের আমল নিয়ে জান্নাত-জাহান্নামের ফয়সালা হবে। পরকালে মানুষের মনে হবে, দুনিয়ায় তারা দিনের সামান্য সময় অতিবাহিত করেছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তিনি যখন (কেয়ামতের দিন) তাদের একত্র করবেন, তাদের মনে হবে, (পৃথিবীতে) তারা যেন দিনের সামান্য সময় অতিবাহিত করেছে। (সেখানে) তারা একে অন্যকে চিনতে পারবে। আল্লাহর সাক্ষাৎ যারা অস্বীকার করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা সৎপথপ্রাপ্ত ছিল না। (সুরা ইউনুস: ৪৫)
এ সংক্ষিপ্ত জীবনের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে পরকালের কথা ভেবে সময়ের সদ্ব্যবহার করা উচিত। বেশি বেশি নেক আমল করলেই মিলবে চূড়ান্ত সার্থকতা। আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু তোমরা তো পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাক।’ (সুরা আলা: ১৬)