জনমতকে উপেক্ষা করেনি ইসলাম। ইসলামি শরিয়তের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়—এমন মতামত সবসময় গুরুত্ব পেয়েছে নবীজি ও খোলাফায়ে রাশেদার শাসনামলে। এজন্য ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসক ও নাগরিকের মধ্যে কোনোরকম প্রতিবন্ধক থাকাও অনুচিত। পরামর্শের ভিত্তিতে যারা কাজ করে, তাদের প্রশংসায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যারা তাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দেয়, নামাজ আদায় করে, পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে।’ (সুরা আশ-শুরা: ৩৮)
মহানবী (স.) বলেন, যে ব্যক্তি জনসাধারণের কোনো দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলো এবং দুর্বল ও অসহায় মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখল, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার আড়ালে থাকবেন। (মুসনাদে আহমদ: ২২০৭৬)
বিজ্ঞাপন
খলিফা ওমর (রা.)-এর যুগে কুফার গভর্নর সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর ব্যাপারে অভিযোগ আসে যে পৃথক ভবন নির্মাণ করেছেন এবং তাতে দরজা লাগিয়েছেন, ফলে জনসাধারণ চাইলেই তাঁর কাছে যেতে পারে না। তখন ওমর (রা.) তাঁকে মদিনায় ডেকে পাঠান। (তারিখে তাবারি: ৩/১৫০)
আরও পড়ুন: ইসলামে শাসকের ১৩ দায়িত্ব
ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মূলনীতি হলো পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সবার পরামর্শ ও মতামতের মূল্য সমান নয়। যারা আল্লাহভীতি, প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞান, ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তার অধিকারী, তাদের মতামত অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সামনে কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয় এলে এবং এ বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না এলে তিনি সাহাবিদের সাধারণ মজলিসে মতামত গ্রহণ করতেন। যেমন বদর যুদ্ধের বন্দি, উহুদ যুদ্ধের অভিযান শুরু, উসমান (রা.)-এর রক্তের বদলা নেওয়া ইত্যাদি।
ইসলামি রাষ্ট্র জনসাধারণকে রাষ্ট্রের সমালোচনা করার অনুমতি দিয়েছে। শুধু অনুমতি দিয়েছে তা নয়, বরং ব্যক্তির যদি মনে হয়, শাসক বা রাষ্ট্র জনসাধারণের প্রতি জুলুম করছে, তবে তার প্রতিবাদ করা মুমিনের দায়িত্ব। খালিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা নবী (স.)-কে বলতে শুনেছি, মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে অত্যাচার করতে দেখে (এবং শক্তি থাকার পরও) তার দুই হাত চেপে ধরে না, অবিলম্বে আল্লাহ তাদের সবাইকে শাস্তি দেবেন। আমর (রহ.) হুসাম (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, যে জাতির মধ্যে পাপ কাজ হতে থাকে, এগুলো বন্ধ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ করা হচ্ছে না, অচিরেই আল্লাহ তাদের সবাইকে চরম শাস্তি দেবেন। (আবু দাউদ: ৪৩৩৮)
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন: শহীদরা যে ৬টি বড় পুরস্কার লাভ করবেন
ইসলামের মহান চার খলিফার সবাই রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁর শাসন কাজের ব্যাপারে জনমতের প্রত্যাশা করে বলেন, ‘বন্ধুরা, আমাকে আপনাদের নেতা নিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও আমি আপনাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান নই। আমি যদি কল্যাণকর কাজ করি তাহলে আমাকে সবাই সাহায্য করবেন আর যদি কোনো খারাপ কাজ করি তাহলে অবশ্যই আমাকে সংশোধন করে দেবেন। সততা ও সত্যবাদিতা হলো আমানত। আর মিথ্যা ও কপটতা হলো খেয়ানত।’ (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ২/৩৫৫)
জাবির বিন সামুরা (রা.) বলেন, কুফাবাসী সাআদ (রা.)-এর বিরুদ্ধে ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করলে তিনি তাঁকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং আম্মার (রা.)-কে তাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। (সহিহ বুখারি: ৭৫৫)
বর্তমান সমাজে আমরা দেখতে পাই, ক্ষমতা পেলে নিজের মর্জিতেই সবকিছু বাস্তবায়ন হয়। জনগণের মতামত নেওয়া তো দূরের কথা, কারোও বক্তব্য অপছন্দ হলে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতেও দ্বিধা করেন না। এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া অন্যকিছু নয়। ইসলামের শিক্ষা হলো- শাসক জনগণের মতামতকে তো সম্মান করবেনই, উপরন্তু নিজের ভুলত্রুটি যাচাই করতেও জনগণের দ্বারস্থ হবেন। এক্ষেত্রে বিশেষ করে রাষ্ট্রের প্রাজ্ঞ ও পণ্ডিতজনের মতামত নেবেন।
আরও পড়ুন: কর্মফল সত্য, আজ যা করবেন কাল তা-ই পাবেন
ওমর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর একবার বিশিষ্ট সাহাবি মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কেমন দেখছেন? তিনি বললেন, আপনাকে আমি যেভাবে দেখতে ভালোবাসি সেভাবেই দেখছি এবং সেটা আপনার জন্য কল্যাণকর। আমি আপনাকে দেখছি রাষ্ট্রের সম্পদ একত্র করতে সামর্থ্যবান, কিন্তু তা থেকে নির্মোহ এবং তা বণ্টনে ন্যায়পরায়ণ। যদি আপনি বিচ্যুত হতেন তবে আপনাকে সোজা করে দিতাম, যেভাবে সাঁচের ভেতর রেখে তীর সোজা করা হয়। ওমর (রা.) বললেন, সব প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি আমাকে এমন জাতির নেতা বানিয়েছেন আমি বিচ্যুত হলে তারা আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। (তারিখুল ইসলাম লিজ-জাহাবি: ৪/১১৪)
ওমর (রা.) নিজে বাজারে ঘুরে বেড়াতেন, রাতের অন্ধকারে শহর পরিদর্শন করতেন। তারপরও তিনি জনমতের নামে উত্থাপিত বিষয়গুলোকে যাচাই করে দেখতেন। যেমন কুফাবাসীর অভিযোগ পেয়ে তিনি সাআদ (রা.)-কে প্রশাসক পদ থেকে সরিয়ে দিলেও তাদের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য সেখানে লোক পাঠান। আর তারা সেখানে গিয়ে বিপরীত দৃশ্য দেখতে পান। ইমাম বুখারি (রহ.) বর্ণনা করেন, ওমর (রা.) কুফার অধিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে সাআদ (রা.)-এর সঙ্গে কুফায় পাঠান। তারা প্রতিটি মসজিদে গিয়ে সাআদ (রা.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল এবং উপস্থিত মুসল্লিরা সবাই তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করল। (সহিহ বুখারি: ৭৫৫)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম নেতাদের বুঝার তাওফিক দান করুন। আমিন।

