ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ে নিষেধ একটি মহান ইবাদত। এটি প্রত্যেকের অত্যাবশ্যকীয় দায়িত্ব। ইসলামি পরিভাষায় একে বলা হয় ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার’। একটি কল্যাণকামী সমাজ ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমর বিল মারুফ তথা সৎকাজের আদেশ যেমন জরুরি, তেমনি নেহি আনিল মুনকার তথা অসৎকাজে নিষেধও জরুরি।
আল্লাহ তাআলা যে দুইটি মৌলিক উপাদানের কারণে মুসলিম উম্মাহকে শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকামী জাতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন, তন্মধ্যে এই দুটি কাজ অন্যতম। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণে তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০)
বিজ্ঞাপন
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি জাতি হওয়া উচিত যারা সব ভালো কাজের দিকে আহ্বান করবে, সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে, প্রকৃতভাবে তারাই সফলকাম সম্প্রদায়।’ (সুরা আলে ইমরান: ১০৪)
অসৎকাজে নিষেধ করা মুমিনের অন্যতম গুণ। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা হচ্ছে আল্লাহর দিকে বারবার প্রত্যাগমনকারী, তাঁর ইবাদতকারী, তাঁর প্রশংসাবাণী উচ্চারণকারী, তাঁর জন্য জমিনে বিচরণকারী, তাঁর সামনে রুকু ও সেজদাকারী, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের বাধা দানকারী এবং আল্লাহর সীমারেখা সংরক্ষণকারী। (সুরা তাওবা: ১১২)
আরও পড়ুন: গুনাহ নেকিতে পরিণত হয় যে আমলে
এমন গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে নারীদেরও ভূমিকা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, তারা সবাই পরস্পরের বন্ধু ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের হুকুম দেয় এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সুরা তাওবা: ৭১)
বিজ্ঞাপন
যারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দেওয়ার কাজে এগিয়ে আসে না, তাদের নিন্দাবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে। ইরশাদ হয়েছে, ‘বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তাদের ওপর দাউদ ও মরিয়ম পুত্র ঈসার (আ.) মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি করতে শুরু করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্মপদ্ধতি বড়ই জঘন্য ছিল।’ (সুরা মায়েদা: ৭৮-৭৯)
অন্যায়ে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে কমপক্ষে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করতে হবে। নবী (স.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো খারাপ কাজ বা বিষয় দেখে তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা করতে অপারগ হয় তাহলে যেন মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করে, যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে, আর এটাই হচ্ছে ঈমানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম স্তর।’ (বুখারি: ১৯৪)
আরও পড়ুন: যে আমলের মর্যাদা জান্নাতের ফলবাগানে অবস্থানের মতো
সমাজে এই ইবাদতের চর্চা বন্ধ হয়ে গেলে ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। অবুঝ ও গাফেল ব্যক্তিরা আল্লাহর পথ চিনতে পারে না। ফলে অন্যায় কাজে ডুবে থাকে মানুষ। তখন মহান আল্লাহর ক্রোধ বেড়ে যায়। ওই সমাজে আজাব নেমে আসে এবং তাদের কোনো দোয়াও কবুল করা হয় না।
তাছাড়া মুসলিম সমাজের মানুষ যখন এই ইবাদত (ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধ) পরিত্যাগ করবে, তখন আল্লাহ তাআলা খারাপ মানুষকে সেই সমাজের কর্ণধার বানিয়ে দেবেন। একইসঙ্গে ভালো ও নেককার মানুষের দোয়াও কবুল করবেন না। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি—তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তাঁর নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না।’ (তিরমিজি: ৪/৪০৬, নম্বর: ২১৬৯, ভা-২/৪০)
দ্বীনের অত্যাবশ্যকীয় এই দাওয়াতের গুরুত্ব ও ছেড়ে দেওয়ার ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য মহানবী (স.) একটি অনন্য উদাহরণ দিয়েছেন। নোমান ইবনে বশির (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) বলেছেন, যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচ তলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়) কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙ্গিয়ে যেত। তখন নিচ তলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই (তবে ভালো হয়) এ অবস্থায় তারা যদি এদের আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয় তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে), তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে। (বুখারি: ২৪৯৩)
অতএব, সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করাকে দায়িত্ব হিসেবে নিতে হবে। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাওফিক দান করুন। আমিন।