তারাবির নামাজ পবিত্র রমজানের অন্যতম প্রতীক। রমজান মাসে এশার নামাজের পর বিতিরের আগে যে ২০ রাকাত নামাজ জামাতে পড়া হয় তা-ই তারাবি নামে পরিচিত। এই নামাজ নারী-পুরুষ সকলের জন্য সুন্নত। মুসলমানদের হৃদয়ে রয়েছে তারাবি নামাজের অনেক মর্যাদা ও মহত্ত্ব। আল্লাহ তাআলার কাছেও এর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে।
হাদিস শরিফে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (সহিহ বুখারি: ৩৭)
বিজ্ঞাপন
হাদিসটিতে অতীত গুনাহ বলতে বিশুদ্ধ মতানুযায়ী সগিরা গুনাহ উদ্দেশ্য। কবিরা গুনাহের জন্য অবশ্যই খালেস নিয়তে তাওবা করতে হবে।
তারাবি হলো কিয়ামুল্লাইলের অন্তর্ভুক্ত। তারাবি (আরবি উচ্চারণে তারাবীহ) শব্দের অর্থ বিশ্রাম করা। বিরতি নিয়ে এই নামাজ পড়া হয় বিধায় একে তারাবি বলা হয়। সলফে সালেহিন (সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িগণের প্রজন্ম) যখন এই নামাজ আদায় করতেন, প্রতি চার রাকাত অন্তর বিরতি নিতেন। মূলত তারা মহান মৌসুমকে কাজে লাগাতে ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় নামাজকে দীর্ঘ করার কারণে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তাই বিরতি নিয়ে রাতের নামাজ পড়তেন। সাধারণত তারাবি এবং বিতির মিলে হয় কিয়ামুল্লাইল। কেউ চাইলে রমজানে ২০ রাকাতের বেশি নামাজও পড়তে পারেন। সবশেষে বিতির পড়বেন। তখন তার এশাপরবর্তী তারাবিসহ সব ইবাদত মিলে হবে কিয়ামুল্লাইল।
আরও পড়ুন: দ্রুত তারাবি পড়লে যে ক্ষতি
সর্বপ্রথম তারাবির নামাজ পড়েছেন কে?
ইবনে কুদামা (রহ) তাঁর বৃহৎ ও বিস্তৃত গ্রন্থ আলমুগনিতে বলেন- তারাবির নামাজ সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সর্বপ্রথম যিনি এই নামাজ চালু করেছেন তিনি হলেন রাসুলে কারিম (স.)। বিষয়টি একাধিক হাদিসে বিবৃত হয়েছে। যেমন-
বিজ্ঞাপন
১. আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলে কারিম (স.) রমজানের কিয়াম তথা রাতের বেলা ইবাদত-বন্দেগির উৎসাহ দিতেন। কিন্তু দৃঢ়তার সাথে নির্দেশ দিতেন না। তিনি বলতেন- ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমযানের রাতে ইবাদত করবে তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (সহিহ মুসলিম: ৭৫৯)
২. আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন- ‘রমজানের এক রাতে রাসুলে কারিম (স.) মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। কিছুসংখ্যক সাহাবি তাঁর পেছনে ইক্তেদা করেছেন। দ্বিতীয় রাতেও তিনি নামাজ পড়েছেন। এ রাতে প্রচুর মুসল্লি হয়েছে। এরপর তৃতীয় বা (রাবি বলেছেন) চতুর্থ রাতে সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে জড়ো হয়েছেন; কিন্তু ওই রাতে তিনি কামরা থেকে বের হননি। সকাল হলে তিনি সাহাবাদের লক্ষ করে বললেন, তোমরা যে এসেছো তা আমি দেখেছি। তবে, আমি তোমাদের কাছে আসিনি এ আশঙ্কায় যে, না জানি এই নামাজ তোমাদের উপর ফরজ করে দেওয়া হয়। (সহিহ মুসলিম: ৭৬১)
আরও পড়ুন: তারাবি না পড়লে রোজা মাকরুহ হবে?
৩. আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত- ‘একদা রাসুলে কারিম (স.) কামরা থেকে বের হয়ে মসজিদে আসলেন। দেখেন, কিছু লোক মসজিদের এককোণে নামাজ পড়ছে। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কী করছে? বলা হলো, তারা নিজেরা কোরআনের হাফেজ নয়, তাই উবাই ইবনে কা’বের পিছনে নামাজ পড়ছে। তখন নবী কারিম (স.) বললেন, তারা ঠিক করেছে। কাজটা খুব ভালো হয়েছে। (সুনানে আবু দাউদ: ১৩৭৭)
সুতরাং রাসুলে কারিম (স.) তারাবির নামাজ প্রথম পড়েছেন—এতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপরও বলা হয়, ওমর (রা.) তারাবির নামাজ চালু করেছেন। এর কারণ হলো- তিনিই সর্বপ্রথম উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর পেছনে জামাতের ব্যবস্থা করেছেন। তার নির্দেশে উবাই ইবনে কা’ব (রা.) লোকদের নিয়ে তারাবির জামাত শুরু করেছেন। আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারি (রহ) বলেন- ‘রমজানের এক রাতে ওমর (রা.)-এর সাথে বের হলাম। দেখি, লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে ছোট ছোট জামাত করে নামাজ পড়ছে। কেউ একা একা পড়ছে আর কেউ ইমামতি করছে, কিছু লোক তার ইক্তেদা করছে। ওমর (রা.) বললেন, মনে হচ্ছে, সবাইকে যদি এক ইমামের পেছনে জমা করিয়ে দিই তাহলে ভালো হবে। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন এবং সবাইকে উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর পেছনে দাঁড় করিয়ে দেন।
আরেক রাতে তাঁর সাথে বের হলাম। লোকজন উবাই ইবনে কা’ব (রা.)-এর পেছনে জামাতের সাথে নামাজ পড়ছেন। ওমর (রা.) তখন বললেন, এটা উত্তম বিদআত। সাহাবায়ে কেরাম রাতের প্রথমাংশে (তারাবির) নামাজ পড়তেন। ওমর (রা.) বললেন, এই নামাজ থেকে ওই নামাজ উত্তম, যার সময় তারা ঘুমিয়ে থাকে। অর্থাৎ শেষ রাতের নামাজ। (সহিহ বুখারি: ২০১০; আলমুগনি, ইবনে কুদামা: ২/১৬৬)
আরও পড়ুন: তারাবি পড়িয়ে হাদিয়া নেওয়ার বিধান
এসব হাদিস থেকে স্পষ্ট বুঝে আসে যে, সর্বপ্রথম যিনি তারাবির নামাজ পড়েছেন তিনি হলেন সায়্যিদুনা রাসুলে কারিম (স.)। তিনি সাহাবিদের নিয়ে তিন বা চার রাতে তারাবির জামাত করেছেন। এরপর তাঁদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে আর জামাত করেননি। কেননা, তিনি আশঙ্কা করেছেন, তিনি নিয়মিত জামাতের সাথে তারাবির নামাজ পড়লে তারাবির নামাজ ফরজ হয়ে যেতে পারে। ফলে নিয়মিত আদায় করতে না পারলে কবিরা গুনাহ হবে। বিষয়টিকে আরো পরিষ্কার করে নিম্নোক্ত রেওয়ায়েতটি-
‘রমজান মাসে একবার রাসুল (স.) মধ্যরাতে বের হলেন এবং মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেন। কিছু লোক তাঁর পেছনে ইক্তেদা করল। ভোর হলে লোকজন বিষয়টা নিয়ে পরস্পরে আলোচনা করল। পরের রাতে আরো বেশি মানুষ জমা হলো। রাসুলুল্লাহ (স.) মসজিদে গিয়েছেন, তারা তাঁর পেছনে নামাজ পড়েছে। সকাল হলে লোকেরা তা নিয়ে আরো বেশি আলোচনা করল। তাই তৃতীয় রাতে মুসল্লিদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল। নবীজি মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েছেন, লোকেরা তাঁর ইক্তেদা করেছে। চতুর্থ রাতে এত বেশি মুসল্লি হয়েছে যে, মসজিদে সংকুলান হচ্ছে না। কিন্তু রাসুলে কারিম (স.) ওই রাতে নামাজের জন্য বের হলেন না। তা দেখে কিছু লোক আসসালাত, আসসালাত বলে আওয়াজ দিতে লাগল। কিন্তু না, রাসুলে কারিম (স.) বের হলেন না। একেবারে ফজরের সময় মসজিদে গিয়েছেন। ফজরের নামাজ শেষ হলে তিনি মুসল্লিদের দিকে ফিরলেন এবং খুতবা পড়ে বললেন, শোন! আজ রাতে তোমাদের অবস্থা আমার অজানা নয়। কিন্তু আমি আশঙ্কা করেছি, (নিয়মিত জামাত করলে) না জানি, তারারির নামাজ তোমাদের উপর ফরজ হয়ে যায় আর তখন তা আদায় করতে তোমরা অক্ষম হয়ে যাও।’ (সহিহ বুখারি: ৯২৪; সহিহ মুসলিম: ৭৬১)