নামাজ সুনির্দিষ্ট ফরজ ইবাদত ও ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমান আনার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নামাজ। একজন মুমিনের জন্য প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে, ইশারায়—যে অবস্থায় সম্ভব পড়তেই হবে; ছাড়ার অবকাশ নেই। ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, দেশে-বিদেশে, সাগরে-মহাকাশে যেখানেই অবস্থান করেননা কেন, সুস্থ অবস্থায় নামাজ কাজা করারও সুযোগ নেই। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- اِنَّ الصَّلٰوۃَ کَانَتۡ عَلَی الۡمُؤۡمِنِیۡنَ کِتٰبًا مَّوۡقُوۡتًا ‘নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩)
নামাজ দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিধান
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের অনেক জায়গায় মুমিনদের নামাজের নির্দেশ দিয়েছেন। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- وَاَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتُوا الزَّكٰوةَ وَارْكَعُوْا مَعَ الرّٰكِعِیْنَ ‘এবং তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত আদায় করো আর রুকুকারীদের সঙ্গে রুকু করো। (সুরা বাকারা: ৪৩)
বিজ্ঞাপন
যেকোনো নির্দেশনার গুরুত্ব আদেশকারীর মর্যাদা, আদেশের ধরণ ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে। নামাজের নির্দেশনা একে তো মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের, তার ওপর আদেশের বিভিন্ন ধরণ দেখলে মুমিন মাত্রই উপলব্ধি করে যে এই আদেশ লঙ্ঘন করার সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনে নামাজের ভয় দেখিয়ে, পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে, নবীজিকে উদ্দেশ্য করে, নবীপত্নীদের উদ্দেশ্যে ও আলাদা করে সকল মুমিনের উদ্দেশ্যে নামাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আবার এমন এমন অবস্থা ও প্রেক্ষাপটে নামাজের বিভিন্ন নির্দেশনা এসেছে, যা একজন মুমিনকে ভাবিয়ে তোলে। শরীরে প্রাণ থাকতে নামাজ ছেড়ে দেওয়া যাবে না—সেটি বুঝতে বাকি থাকে না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন- নামাজ হলো মুমিন ও কাফেরের মধ্যে পার্থক্যকারী। হাদিসের ভাষায়- ‘বান্দা এবং শিরক ও কুফরের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সালাত ছেড়ে দেওয়া। (মুসলিম: ১৪৮) হাদিসে আরও এসেছে, যার ভেতর নামাজ নেই, তার ভেতর দ্বীনের কোনো হিস্যা নেই। (মুসনাদে বাজ্জার: ৮৫৩৯)
আরও পড়ুন: আউয়াল ওয়াক্তে নামাজ পড়ার ফজিলত
নামাজ আল্লাহর নেয়ামত
নামাজ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ নেয়ামত। নামাজের মাধ্যমে মুমিন কঠিন সময়ে মুক্তি পাবে। আল্লাহ বলছেন- قُلْ لِّعِبَادِیَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا یُقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَیُنْفِقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّعَلَانِیَةً مِّنْ قَبْلِ اَنْ یَّاْتِیَ یَوْمٌ لَّا بَیْعٌ فِیْهِ وَلَا خِلٰلٌ ‘আমার যে বান্দাগণ ঈমান এনেছে তুমি তাদের বলো, তারা যেন নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করে, সেই দিন আসার আগে, যে দিন কোনো বেচাকেনা থাকবে না এবং বন্ধুত্বও থাকবে না।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩১)
অন্যত্র এসেছে- وَاَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ ذٰلِكَ ذِكْرٰی لِلذّٰكِرِیْنَ ‘এবং তুমি নামাজ কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে ও রাতের কিছু অংশে। নিশ্চয় নেক আমলসমূহ মন্দ কর্মগুলোকে দূর করে দেয়। স্মরণকারীদের জন্য এ একটি স্মারক।’ (সুরা হুদ: ১১৪)
বিজ্ঞাপন
দিনের দুই প্রান্তে ও রাতের কিছু অংশে নামাজ বলতে ফজর, জোহর, আছর, মাগরিব ও এশার নামাজ বুঝানো হয়েছে। সেইসঙ্গে বলা হয়েছে, পুণ্য পাপকে দূর করে দেয়। এ থেকে বোঝা যায় নামাজ খুব মর্যাদাপূর্ণ আমল এবং এর দ্বারা গুনাহ মাফ হয়।
অন্য আয়াতে এসেছে- اُتْلُ مَاۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ مِنَ الْكِتٰبِ وَاَقِمِ الصَّلٰوةَ اِنَّ الصَّلٰوةَ تَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللهِ اَكْبَرُ وَاللهُ یَعْلَمُ مَا تَصْنَعُوْنَ ‘ওহির মাধ্যমে তোমার প্রতি যে কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে, তা তেলাওয়াত করো ও নামাজ কায়েম কর। নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে আর আল্লাহর জিকিরই সবচেয়ে বড়। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা জানেন। (সুরা আনকাবুত: ৪৫)
আরও পড়ুন: তাহাজ্জুদ অনুগত বান্দাদের ইবাদত
এখানেও নামাজের আদেশ করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এর কিছু উপকারিতাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, তা অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে। হাঁ, নামাজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে বিরত রাখে।
নামাজ পরকালীন মুক্তির উপায়
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমার যে বান্দাগণ ঈমান এনেছে তুমি তাদের বলো, তারা যেন নামাজ কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে খরচ করে, সেই দিন আসার আগে, যে দিন কোনো বেচাকেনা থাকবে না এবং বন্ধুত্বও থাকবে না।’ (সুরা ইবরাহিম: ৩১)
রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যত্নের সঙ্গে আদায় করবে, কেয়ামতের দিন এ নামাজ তার জন্য আলো হবে। তার ঈমান ও ইসলামের দলিল হবে এবং তার নাজাতের ওসিলা হবে। আর যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত নামাজ আদায় করবে না, কেয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নামাজ তার জন্য আলো হবে না। দলিলও হবে না এবং সে আজাব থেকে রেহাইও পাবে না। (মুসনাদে আহমদ: ৬৫৭৬)
নামাজ ছেড়ে দেওয়ার পরিণাম জাহান্নাম
নামাজ না পড়া পরকালে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘(জাহান্নামিদের জিজ্ঞাসা করা হবে) তোমাদের কোন জিনিস সাকারে (জাহান্নাম) নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে, আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।’ (সুরা মুদ্দাসসির: ৪২-৪৩)
আরও পড়ুন: যেসব আমল করলে জাহান্নামে যেতে হবে না
পবিত্র কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী, কেয়ামতের দিন বেনামাজিকে জাহান্নামের গভীর গর্তে নিক্ষেপ করা হবে। নূহ, ইবরাহিম ও ইসরাঈল (আ.)-এর ব্যাপারে বর্ণনার পর মহান আল্লাহ বলেন, ‘তাদের পরে এল অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা সালাত নষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই ‘গাইয়া’ প্রত্যক্ষ করবে।’ (সুরা মরিয়ম: ৫৯)
‘গাইয়া’ হলো, জাহান্নামের একটি নদীর তলদেশ, যার গভীরতা অনেক, যেখানে আছে রক্ত ও পুঁজের নিকৃষ্টতম আস্বাদ। (তাফসিরে ইবনে কাসির) ‘গাইয়া’ জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম। (তাফসিরে কাশশাফ ও নাসাফি)
বেনামাজির জন্য অপমানজনক শাস্তি
কেয়ামতের দিন বেনামাজি সর্বপ্রথম যে অপদস্থতা ও লাঞ্ছনার শিকার হবে, কোরআনের একটি আয়াতে তার বিবরণ এসেছে— ‘স্মরণ করো সেদিনের কথা, যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচন করা হবে। সেদিন তাদের আহ্বান করা হবে সেজদা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি অবনত, হীনতা তাদের আচ্ছন্ন করবে। অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিল, তখন তো তাদের আহ্বান করা হয়েছিল সেজদা করতে।’ (সুরা কালাম: ৪২-৪৩)
আরও পড়ুন: মেরাজে নবীজির দেখা কিছু পাপের ভয়ঙ্কর শাস্তি
নামাজ না পড়লে কেমন শাস্তি হবে তার কিছুটা অনুমান করা যায় আরেকটি হাদিসে। ‘..এক দিন সকালে রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, ‘আজ রাতে আমার কাছে দুজন আগন্তুক এসেছিল। তারা আমাকে বলল, আমাদের সঙ্গে চলুন। আমি তাদের সঙ্গে গেলাম। আমরা এমন এক লোকের কাছে পৌঁছলাম, যে চিত হয়ে শুয়েছিল। অন্য এক ব্যক্তি পাথর নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে পাথর দিয়ে শুয়ে থাকা ব্যক্তির মাথায় আঘাত করছে এবং থেঁতলে দিচ্ছে। যখন সে পাথর নিক্ষেপ করছে তা গড়িয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। লোকটি গিয়ে পাথরটি পুনরায় তুলে নিচ্ছে এবং তা নিয়ে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটির মাথা পুনরায় পূর্বের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে। সে আবার লোকটির কাছে ফিরে আসছে এবং তাকে পূর্বের মতো শাস্তি দিচ্ছে। আমি আমার সঙ্গী দুজনকে জিজ্ঞাস করলাম- সুবহানাল্লাহ! এরা কারা? তারা জবাবে বলেন, এ ব্যক্তি ফরজ নামাজ না পড়েই ঘুমিয়ে যেত।’ (রিয়াদুস সালেহিন: ১৫৪৬)
নামাজ না পড়ার ইহকালীন শাস্তি
শুধু পরকালীন শাস্তি নয়, নামাজ না পড়লে ইহকালীন জীবনও বরকতশূন্য হয়ে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তির আসরের সালাত কাজা হয় তার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ সবই যেন ধ্বংস হয়ে গেল। (মুসলিম: ১৩০৪)
আরেক বর্ণনায় নামাজ না পড়ার ৬টি দুনিয়াবি শাস্তির উল্লেখ রয়েছে। ১. জীবনের বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে। ২. চেহারা থেকে নূর ও জ্যোতি উঠিয়ে নেওয়া হবে। ৩. ভালো কাজ করলে তার সুফল ভোগ করতে পারবে না। ৪. দোয়া করলে আল্লাহ কবুল করবেন না। ৫. আল্লাহ ও ফেরেশতা অসন্তুষ্ট থাকবেন, ফলে মানসিক অস্থিরতা বিরাজ করবে। ৬. ইসলামের শান্তি ও প্রতিশ্রুতি থেকে বঞ্চিত হবে। (শারহুল আকিদাতুত তাহাবি: ২৬৮)।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যথাসময়ে গুরুত্বসহকারে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর অবাধ্য বান্দার তালিকাভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করুন। আমিন।

