মুসলিম মৃত ব্যক্তির কবর জিয়ারত করা অন্য মুসলমানদের জন্য সুন্নত এবং উপকারী আমল। হাদিসে রাসুল (স.) বলেন, ‘... এখন থেকে কবর জিয়ারত করো। কারণ, তা দুনিয়াবিমুখতা এনে দেয় এবং আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।’ (ইবনে মাজাহ: ১৫৭১)
মানুষ যখন মৃত স্বজন বা অন্যকারও কবর জিয়ারত করে এ সময় কবরে শুয়ে থাকা মৃত স্বজনরা জীবিতদের জিয়ারত ও সালাম শুনতে পান কি না—বিষয়টি সাহাবিদের যুগ থেকেই মতভেদপূর্ণ। কেউ বলেছেন- শুনতে পান, আবার কেউ বলেছেন বিষয়টি নিশ্চিত নয়।
বিজ্ঞাপন
তবে, অধিকাংশ সালাফ, নির্ভরযোগ্য ওলামায়ে কেরাম ও ফকিহদের মতে, মৃতব্যক্তি জিয়ারতকারীর কথা শুনতে পান এবং তার পরিচিতজনকে চিনতেও পারেন। কেননা একাধিক হাদিস ও আছারে এর ইঙ্গিত রয়েছে।
কবরবাসী জীবিতদের সালাম জিয়ারত শোনেন
হাদিস শরিফে রাসুল (স.) বলেন, ‘যখন কোনো মুসলিম ব্যক্তি দুনিয়ায় পরিচিত তার কোনো মৃত ভাইয়ের কবরের পাশ দিয়ে গমন করে এবং তাকে সালাম দেয় তখন তার সালামের জবাব দেওয়ার জন্য আল্লাহ তার রুহকে ফেরত দেন।’ (আল-ইসতিজকার: ১/১৮৫) এ কথা দ্বারা প্রমাণিত যে মৃত ব্যক্তি তাকে চিনতে পারেন এবং তার সালামের জবাব দেন।
রাসুলুল্লাহ (স.) কবরবাসীদের জীবিতদের মতো সম্বোধন করে সালাম দিতে বলেছেন। মুতাওয়াতির (নিরবচ্ছিন্ন) সূত্রে পূর্বসূরি মুসলিম মনীষীদের থেকে অসংখ্য বাণী বর্ণিত আছে যে মৃতব্যক্তি জীবিতদের জিয়ারত (সাক্ষাৎ) বুঝতে পারেন এবং এতে তারা খুশি হন। এছাড়াও সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে জানাজাশেষে কবরের পাশে জীবিতদের কিছুক্ষণ অবস্থান মৃতব্যক্তি পছন্দ করেন। (মুসলিম: ১২১)
বিজ্ঞাপন
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নিকটাত্মীয়ের কবর জিয়ারত করে এবং সেখানে বসে তার জন্য দোয়া করে, মৃত ব্যক্তি তা বুঝতে পারে এবং এতে আনন্দিত হয়।’ (ইবনে কাইয়্যিম, আর-রূহ, পৃষ্ঠা: ৫)
ইমাম কুরতুবি (রহ) বলেন, ‘মৃতরা জীবিতদের কণ্ঠস্বর শুনতে পান এবং তাদের পদচারণাও অনুভব করেন। এ ব্যাপারে সহিহ বর্ণনা রয়েছে।’ (আত-তাজকিরা, পৃষ্ঠা: ১০০–১২০)। তিনি এখানে উল্লেখ করেন, ‘কিছু হাদিস প্রমাণ করে যে, মৃতরা জীবিতদের কথা শুনতে পান, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুভবও করেন। বিশেষ করে, কবর জিয়ারতের সময় তারা চিনতে পারেন—কে এসেছে, কী বলছে ইত্যাদি।’
ইমাম ইবনু তাইমিয়া ও ইমাম ইবনে কাইয়্যিম বলেন, ‘আল্লাহ মৃতদের মাঝে এমন ক্ষমতা দেন যে তারা দুনিয়ার কিছু নির্দিষ্ট সংবাদ ও সম্পর্কিত বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে পারেন।’ (মাজমুউল ফতোয়া: ২৪/৩৬১; ইবনে কাইয়্যিম, আর-রূহ, পৃষ্ঠা: ১৫–৩৫)
উল্লিখিত বাণীগুলো ইসলামি আকিদা ও কবর সংক্রান্ত তাসাউফ ও তাফাক্কুরকে গভীরভাবে বুঝতে সহায়ক। এগুলো কেবল ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং হাদিস ও সাহাবিদের বর্ণনার ভিত্তিতে নির্ভরযোগ্যভাবে সংকলিত।
অতএব, মৃত ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে অচেতন থাকেন না, বরং তাঁদের এক ধরণের ‘বরজাখি জীবন’ (আখেরাত ও দুনিয়ার মাঝে অন্তবর্তী পর্যায়) থাকে, যেখানে তারা কিছু কিছু জাগতিক বিষয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় সচেতন থাকেন—বিশেষত যখন কেউ তাদের কবর জিয়ারত করে এবং দোয়া করে।
তবে, আলেমদের কেউ কেউ মনে করেন, মৃতব্যক্তি জীবিতদের সালাম জিয়ারত শুনতে পান—বিষয়টি অনিশ্চিত। যেমন, শায়খ ইবন বায (রহ.) বলেছেন, ‘মৃত ব্যক্তিরা জীবিতদের সালাম শুনতে পান-বিষয়টি সহিহ হাদিদের আলোকে প্রমাণিত নয়। তাই তারা জীবিতদের কথা শুনতে পান—কথাটি যথাযথ নয়। কেননা মৃত্যু মানেই হচ্ছে জ্ঞানের অবসান ও ইহজাগতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া। রাসুল (স.) আমাদের কবরবাসীদের সালাম দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, এটি একটি ইবাদত ও দোয়া মাত্র। এটি শ্রবণশক্তির ওপর নির্ভর করে না।’ (মাজমু ফতোয়া বিন বায: খণ্ড: ১৩, পৃষ্ঠা: ২৪৮-২৫০)
কবর জিয়ারতের দোয়া
১. السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالأَثَرِ উচ্চারণ: ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর; ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম, আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আ-সার।’ অর্থ: ‘হে কবরবাসী! তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের ক্ষমা করুন, তোমরা আমাদের আগে কবরে গিয়েছ এবং আমরা পরে আসছি।’ (সুনানে তিরমিজি: ১০৫৩)
২. السَّلامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤمِنينَ وإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاحِقُونَ উচ্চারণ: ‘আসসালামু আলাইকুম দারা ক্বাওমিম মুমিনিন ওয়া ইন্না ইনশাআল্লাহু বিকুম লা-হিকুন।’ অর্থ: ‘মুমিন এই ঘরবাসীদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। ইনশাআল্লাহ আমরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হবো।’ (মুসলিম: ২৪৯)

