সুরা কাহাফ পবিত্র কোরআনের ১৮তম সুরা। কাহাফ মানে গুহা। আসহাবে কাহাফের বিখ্যাত সাত যুবকের ঘটনা এই সুরায় বর্ণিত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে ‘সুরা কাহাফ’। ১১০ আয়াতের এই সুরায় চারটি ঘটনা রয়েছে। প্রত্যেক ঘটনার সঙ্গে রয়েছে মূল্যবান শিক্ষা।
সুরা কাহাফের ৯ থেকে ২৬ আয়াতে আছে আসহাবে কাহাফের ঘটনা। ৩২ থেকে ৪৪ আয়াতে দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা রয়েছে। মুসা (আ.) ও খিজির (আ.) ঘটনা এবং জুলকারনাইন সম্পর্কিত ঘটনার উল্লেখ রয়েছে ৬০ থেকে ১০১ আয়াতে। নিচে এসব ঘটনার সঙ্গে মহামূল্যবান শিক্ষা তুলে ধরা হলো।
বিজ্ঞাপন
আসহাবে কাহাফের ঘটনা
অবিশ্বাসে ভরা সমাজে কয়েকজন যুবক আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁরা একটি গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেখানে আল্লাহ তাঁদের সবাইকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখলেন। ঘুম ভাঙার পর তাঁরা বুঝতেই পারেননি, তাঁদের ঘুমের মধ্যে আল্লাহ অনেকগুলো বছর অতিবাহিত করে ফেলেছেন। এ অবস্থায় তাঁদের একজন খাবার কিনতে শহরে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, লোকজন তাঁকে চিনে ফেলবে এবং তাঁর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলেন, কেউ তাঁকে চেনে না। খাবার কিনে টাকা পরিশোধ করার সময় পুরোনো মুদ্রা দেখে শহরের লোকেরা হতবাক হয়ে গেল।
এ ঘটনার তাৎপর্য একাধিক। যেমন—আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করে থাকেন। এছাড়াও দ্বীনকে বাঁচানোর জন্য সবকিছু ছেড়ে অন্যত্র হিজরত করা ও আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা রয়েছে এই ঘটনায়।
আরও পড়ুন: গুনাহ করতে করতে ক্লান্ত, তাদের জন্য কোরআনের উপদেশ
দুই বাগানের মালিকের ঘটনা
এক ব্যক্তির সুন্দর একটি বাগান ছিল। কিন্তু লোকটি ছিলেন অহংকারী। পবিত্র কোরআন আছে, ‘আর তার প্রচুর ধনসম্পদ ছিল, তারপর কথায় কথায় সে তার বন্ধুকে বলল, ধনসম্পদে আমি তোমার থেকে বড় এবং জনবলেও তোমার চেয়ে শক্তিশালী।’ (সুরা কাহাফ: ৩৪)
অহংকারী হয়ে আল্লাহর নেয়ামতের কথা ভুলে যাওয়ায় আল্লাহ তাঁর বাগান ধ্বংস করে দেন। ঘটনাটি তাদের জন্য, যারা নিজের অহংবোধে আল্লাহর নেয়ামতের কথা ভুলে যায়। তাঁরা ভুলে যায় যে আল্লাহ চাইলেই মুহূর্তে তাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিতে পারেন।
বিজ্ঞাপন
হজরত মুসা ও খিজির (আ.)-এর ঘটনা
খিজির (আ.)–এর সঙ্গে সফর করার সময় তিনটি ঘটনা সংঘটিত হতে দেখেন হজরত মুসা (আ.)। প্রথম ঘটনায় খিজির (আ.) একটি নৌকা ছিদ্র করে ফেলেন, অথচ নৌকার মালিক বিনা ভাড়ায় তাঁকে নৌকায় উঠিয়েছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনায় তিনি একটি নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেন। তৃতীয় ঘটনায় তিনি একটি দেয়াল উঠিয়ে দেন। ঘটনা তিনটি দেখে মুসা (আ.) চুপ থাকতে পারলেন না। তখন খিজির (আ.) ঘটনাগুলোর তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা দেন। মুসা (আ.) বুঝতে পারলেন আল্লাহ কীভাবে কাউকে কাউকে অন্তর্দৃষ্টি দেন, যাতে তাঁরা সুদূরপ্রসারী অর্থে এমন কাজ করতে পারেন যাকে আপাতদৃষ্টিতে বোধগম্য বলে মনে হয় না।
ধৈর্য, আনুগত্য ও শুকরিয়া জ্ঞাপনের শিক্ষা রয়েছে এখানে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো-জ্ঞান নিয়ে অহংকার করা অনুচিত। সব জ্ঞানের অধিকারী কেবলই আল্লাহ। খিজির (আ.) নিজেও বলেছেন, ‘আমি আমার ইচ্ছায় কিছুই করিনি।’ (সুরা কাহাফ: ৮২) পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর এ-দেওয়ালটি ছিল শহরের দুই এতিমের। তার নিচে ছিল গুপ্তধন। আর ওদের পিতা ছিল এক সৎকর্মপরায়ণ লোক। সে জন্য তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলেন যে ওরা যেন সাবালক হয় ও তারপর ওরা ওদের ধন উদ্ধার করে। আমি নিজ থেকে কিছু করিনি। তুমি যে-বিষয়ে ধৈর্য রাখতে পারনি এটাই তার ব্যাখ্যা।’ (সুরা কাহাফ: ৮২)
আরও পড়ুন: প্রতিদিন কোরআন তেলাওয়াতের বিস্ময়কর ফজিলত
বাদশাহ জুলকারনাইনের ঘটনা
জুলকারনাইন ন্যায়পরায়ণ ও সৎ বাদশাহ ছিলেন। তিনি পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত সফর করেছিলেন। দুই পর্বতের মাঝখানে তিনি এক জনগোষ্ঠীকে খুঁজে পান। তারা তাঁর কাছে ইয়াজুজ ও মাজুজের হাত থেকে রক্ষা পেতে একটি দেয়াল নির্মাণের আবেদন জানাল। জুলকারনাইন কাজটি করে দিতে সম্মত হলেন। তিনি তাঁর কাজ নিয়ে গর্ব দেখাননি। অর্থাৎ এই ঘটনায় অহংকার পরিত্যাগ করার শিক্ষা রয়েছে।
দেয়াল তৈরির পর তাঁর ভাষণ পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘এ আমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ। যখন আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে তখন তিনি ওকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবেন, আর আমার প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি সত্য।’ (সুরা কাহাফ: ৯৮)
মূল পরীক্ষা চারটি
ওপরের চারটি ঘটনা থেকে চার রকম পরীক্ষার কথা জানা যায়। আসহাবে কাহাফের ঘটনা থেকে ধর্মবোধের পরীক্ষা, দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা থেকে সম্পদের ওপর পরীক্ষা, মুসা (আ.) ও খিজির (আ.)-এর ঘটনায় জ্ঞান সম্পর্কে এবং জুলকারনাইনের ঘটনা থেকে ক্ষমতা নিয়ে পরীক্ষা।
আরও পড়ুন: কোরআন যাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করে না
সুরা কাহাফে দাওয়াত চারটি
সুরা কাহাফের চার ঘটনায় দাওয়াতের কথা রয়েছে। ১৪ নম্বর আয়াতে যুবকেরা বাদশাহকে দাওয়াত দিয়েছেন (আসহাবে কাহাফের ঘটনা)। ৩৭ নম্বর আয়াতে একজন সঙ্গী আরেক সঙ্গীকে দাওয়াত দিয়েছে (দুটি বাগানের মালিকের ঘটনা)। ৭০ নম্বর আয়াতে একজন শিক্ষক তার ছাত্রকে দাওয়াত দিয়েছে (হজরত মুসা (আ.) এবং জ্ঞানী ব্যক্তির ঘটনা)। ৮৭-৮৮ আয়াতে একজন শাসক তার প্রজাদের দাওয়াত দিয়েছে (জুলকারনাইনের ঘটনা)।
প্রসঙ্গত, জুমার দিন সুরা কাহাফ পাঠের বিশেষ ফজিলত রয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ তেলাওয়াত করবে, তার (ঈমানের) নূর এই জুমা হতে আগামী জুমা পর্যন্ত চমকাতে থাকবে। (মেশকাত: ২১৭৫)
আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের প্রথম ১০ আয়াত মুখস্থ করবে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে নিরাপদ থাকবে। (সহিহ মুসলিম: ৮০৯; আবু দাউদ: ৪৩২৩)
আরেক বর্ণনায় আছে, ‘যে ব্যক্তি সুরা কাহাফের শেষ ১০ আয়াত পড়বে, সে দাজ্জালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাবে।’ (মুসনাদে আহমদ: ৪৪৬/৬)
আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যেভাবে নাজিল করা হয়েছে, সেভাবে যে ব্যক্তি সুরা কাহাফ পড়বে, তার জন্য সেটা নিজের স্থান থেকে মক্কা পর্যন্ত আলো হবে এবং শেষ ১০ আয়াত পড়লে দাজ্জালের গণ্ডির বাইরে থাকবে আর দাজ্জাল তার ওপর কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। (সুনানে নাসায়ি: ১০৭২২)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুরা কাহাফের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার তাওফিক দান করুন। আল্লাহ তাআলার আদেশ যথাযথ মেনে জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।

