মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

জবাবদিহিতাকে যেভাবে ভয় করতেন সালাফরা

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: ২০ আগস্ট ২০২৩, ০১:৪৭ পিএম

শেয়ার করুন:

জবাবদিহিতাকে যেভাবে ভয় করতেন সালাফরা

মানুষ মাত্রই দায়িত্বশীল। রাজা-প্রজা, নারী-পুরুষ, ধনী-গরিব কেউ জবাবদিহিতার বাইরে নয়। আবদুল্লাহ ইবনু ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির ওপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোনো ব্যক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহিহ বুখারি: ৬৬৫৩)

জবাবদিহি দুই রকম। মানুষের কাছে জবাবদিহি এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি। মানুষের কাছে জবাবদিহির অনুভূতি কমে গেলে বা বিলুপ্ত হলে মানুষ ও সমাজ যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তার চেয়ে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আল্লাহর কাছে জবাবদিহির অনুভূতি হারিয়ে গেলে। আর আল্লাহর কাছে অপরাধ ঢাকার সুযোগ নেই। তিনি নিজেই সবকিছুর সাক্ষী। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে জমিন ও আসমানের কোনো কিছুই গোপন থাকে না।’ (সুরা আল-ইমরান: ৫) তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘মানুষের চোখের চোরা চাহনি এবং তাদের অন্তরে যা কিছু লুকিয়ে থাকে, সবই তিনি জানেন।’ (সুরা মুমিন: ১৯)


বিজ্ঞাপন


পবিত্র কোরআনে আরও এসেছে, ‘আর যে লোক আত্মসাৎ করবে সে কেয়ামতের দিন সেই আত্মসাৎকৃত বস্তু নিয়ে আসবে। অতঃপর পরিপূর্ণভাবে পাবে প্রত্যেকে, যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোনো অন্যায় করা হবে না।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬১)

হজরত আদি ইবনু উমাইরা আল-কিন্দি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, হে লোকেরা! তোমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সরকারি কোনো পদে নিয়োগ করার পর সে যদি আমাদের তহবিল হতে একটি সুঁই কিংবা তার অধিক আত্মসাৎ করে তবে সে আত্মসাৎকারী। কেয়ামতের দিন সে তার এই আত্মসাতের বোঝা নিয়ে উপস্থিত হবে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৫৮১)

আরও পড়ুন: যে ফেতনাকে সাহাবিরাও ভয় পেতেন

তাই জবাবদিহিতাকে ভয় করতে হবে। যদি প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে সজাগ হয় এবং আখেরাতে জবাবদিহির অনুভূতি হৃদয়ে জাগরূক থাকে তাহলে সমাজের সিংহভাগ সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কারণ, মুমিন সবকিছুই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করে। আল্লাহর ভয়ে অন্যায় থেকে বিরত থাকে। পূর্ববর্তী মুসলিমদের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তাঁরা আল্লাহর কাছে জবাব দেওয়ার ভয়ে কাতর থাকতেন। দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর ব্যাপারে বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন সৎকাজের ওজনের পাল্লা হালকা হওয়ার ভয়েই তিনি খেলাফতকালে এক প্রকার নির্ঘুম থাকতেন। তিনি বলতেন, যদি আমি রাতে ঘুমাই, তাহলে আমি নিজেকে ধ্বংস করলাম। আর যদি দিনে ঘুমাই, তাহলে প্রজাদের শেষ করলাম। কেননা আমি তাদের ওপর দায়িত্বশীল। (আল-খুতাত লিল মাকরিজি: ১/৩০৮)


বিজ্ঞাপন


ইসলামের পঞ্চম খলিফা খ্যাত ওমর বিন আবদুল আজিজ (৯৯-১০১ হিজরি) এর জীবনীতে জবাবদিহিতার এক চমৎকার শিক্ষা রয়েছে। একবার রাতের বেলা তিনি মোটা মোমবাতি জ্বেলে কর্মকর্তাদের ডেকে প্রজাদের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলেন। এমন সময় একজন বলে উঠল, হে আমিরুল মুমিনিন! আপনার নিজের অবস্থা এবং পরিবারের অবস্থা কেমন? তখন তিনি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন এবং গোলামকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন, চেরাগবাতি নিয়ে আসো। কিছুক্ষণ পরে চেরাগ এলো, তবে তা নিবু নিবু ছিল। তখন তিনি বললেন, তুমি এখন যা খুশি আমাকে প্রশ্ন করো। এরপর তিনি তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলেন। প্রশ্নপর্ব শেষে ওই ব্যক্তি তাকে বড় মোমবাতিটি নিভিয়ে দিয়ে নিবু নিবু চেরাগ আনার কারণ কী জিজ্ঞেস করল। জবাবে খলিফা বললেন, হে আল্লাহর বান্দা! বড় মোমবাতিটি আমি নিভিয়ে দিয়েছি, কারণ সেটি ছিল আল্লাহর ও মুসলমানদের সম্পদ। তার আলোয় আমি প্রজাদের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিলাম। কিন্তু যখন তুমি আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে, তখন আমি তাদের মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলাম। (সিরাতু ওমর ইবনু আবদুল আজিজ: ১৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা)

এটাই হচ্ছে প্রকৃত মুসলিমের জবাবদিহিতার ভয়। জবাবদিহির অনুভূতি ও দায়িত্বজ্ঞানের তীব্রতা মুসলিম নেতাদের মধ্যে এমনই ছিল। একদিন তিনি প্রচণ্ড সূর্যতাপে সদকার উটের পরিচর্যা করছিলেন। এমন সময় বনু তামিম গোত্রের নেতা আহনাফ বিন কায়েস ইরাক থেকে একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আসেন। যখন তারা তার নিকটবর্তী হলেন, তখন ওমর (রা.) আহনাফকে ডেকে বললেন, হে আহনাফ! কাপড়-চোপড় রেখে দ্রুত এসো এবং উট পরিচর্যার ব্যাপারে আমিরুল মুমিনিনকে সাহায্য করো। কেননা এগুলো সদকার উট। এর মধ্যে এতিম-মিসকিন ও বিধবাদের হক রয়েছে। তখন একজন বলল, ‘হে আমিরুল মুমিনিন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনি সদকা খাতের কোনো একজন কর্মীকে এ কাজের নির্দেশ দিলেই তো যথেষ্ট ছিল। জবাবে ওমর (রা.) বললেন, আমার চেয়ে ও আহনাফের চেয়ে বড় গোলাম আর কে আছে? কেননা যে ব্যক্তি মুসলমানদের কোনো দায়িত্বে থাকে, তার ওপর ওভাবে দায়িত্ব পালন করা ওয়াজিব, যেভাবে মনিবের প্রতি একজন গোলামের দায়িত্ব পালন করা আবশ্যক।’ (তারিখু উমর লি-ইবনিল জাওজি, পৃষ্ঠা-৮৯)

আরও পড়ুন: সোয়া লাখ সাহাবির কবর ছড়িয়ে আছে যেসব দেশে

আব্বাসীয় খলিফা মুক্তাদি বি আমরিল্লাহর (৪৬৭-৪৮৭ হিজরি) মন্ত্রী আবু শুজার কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল, ‘আমাদের প্রতিবেশী একজন বিধবা আছেন, যার চারটি সন্তান রয়েছে। ওরা কাপড়-চোপড়হীন ও ক্ষুধার্ত।’ কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী একজন লোক দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র ও কিছু নগদ অর্থ পাঠিয়ে দেন। অতঃপর তীব্র শীত পড়া অবস্থায় নিজের দেহের পোশাক খুলে রেখে দিয়ে বলেন, আল্লাহর কসম! যতক্ষণ পর্যন্ত এই ব্যক্তি আমার কাছে তাদের খবর না নিয়ে আসবে, ততক্ষণ আমি এই পোশাক পরব না। লোকটি দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে এসে বলল, তারা খুবই খুশি হয়েছে এবং মন্ত্রীর জন্য দোয়া করেছে। এ কথা শোনার পর মন্ত্রী তার কাপড় পরলেন। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ: ১২/১৫০-৫১)

বিস্ময়কর হলেও সত্য, একজন প্রজার দেহে কাপড় নেই শুনে মন্ত্রী নিজের দেহের কাপড় খুলে রেখে দিলেন। আর খবর না আসা পর্যন্ত ওভাবেই প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে থাকলেন। এটাই ছিল আল্লাহভীরু মন্ত্রী ও শাসকদের দৃষ্টান্ত। তারা জানতেন কেয়ামতের দিন প্রত্যেক মানুষকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। তা হলো জীবন সে কোন কাজে ব্যয় করেছে? যৌবন কোন কাজে শেষ করেছে? কোন পথে আয় ও ব্যয় করেছে? যেটুকু ইলম শিখেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে? (তিরমিজি: ২৪১৬)

আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় না থাকলে মানুষ যা খুশি করতে পারে। পরের হক নষ্ট করতে পারে। অসহায়ের ওপর চড়াও হতে পারে। অহংকারের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে। হামান, কারূন, নমরূদ, ফেরাউন, আবু জেহেল, আবু লাহাব ও ইয়াজিদের মতো মানুষরা জবাবদিহিতাকে ভয় করে না। তারা মানবজাতীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ।  ঈমানদার কখনও জবাবদিহিতাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। শাসক হলে তো অবশ্যই বেশি সচেতন থাকতে হবে। কেউ অভুক্ত আছে কি না, কারো ওপর অজান্তে জুলুম হয়ে যাচ্ছে কি না সেই ভয়ও থাকা উচিত মুসলিম শাসকদের। সিরাতে আমরা দেখতে পাই, মহানবী (স.) যাদেরকেই বিভিন্ন অঞ্চলের শাসনকার্যের দায়িত্ব দিতেন, সবাইকে মজলুমের বদদোয়া থেকে সতর্ক করতেন। অসাবধানতার কারণে যেন কারো ওপর জুলুম না হয়ে যায়। মজলুমের আর্তনাদ আল্লাহর কাছে পৌঁছতে কোনো পর্দা ভেদ করতে হয় না। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (স.) যখন মুআজ (রা.)-কে ইয়েমেনে পাঠান, তাকে বলেন, ‘মজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মধ্যে পর্দা থাকে না।’(বুখারি: ২৪৪৮)

মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তাআলা অনেক ক্ষেত্রে পরকালে জবাব নেওয়ার লম্বা সময় দেন না। অনেক সময় তিনি দুনিয়াতেই হিসাব নিয়ে থাকেন। সীমা লঙ্ঘনকারীদের গজব দিয়ে ধ্বংস করে দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর তাদের সবাইকেই আমি (তাদের) নিজ নিজ পাপের কারণে পাকড়াও করেছি, তাদের কারো ওপর প্রচণ্ড ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে মহাগর্জন এসে আঘাত হেনেছে, কাউকে আমি জমিনের নিচে গেড়ে দিয়েছি, আবার কাউকে আমি (পানিতে) ডুবিয়ে দিয়েছি’। (সুরা আনকাবুত: ৪০)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যার যার দায়িত্ব যথাযথ পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর