তোমার সাথে এসব প্রসঙ্গে এত কম কথা হয়েছে যে বলাই হয়নি। অবশ্য কাউকেই কখনোই বলা হয়নি। বলার কথাও না, বারণ আছে। তবে তোমাকে বলতে পারি। তুমি তো আমাদের এসব গোপন কথা আর কাউকে বলবে না, তাই না? তোমার মনে আছে কিনা জানি না, আমাদের কয়েক বাড়ি পরে ঈশরাত নামে এক আপু ছিল। বলেছিলাম কখনো? যাই হোক, ঈশরাত আপু বেশ সুন্দর ফর্সা লম্বা আর গোলগাল দেখতে। তোমার মতো তারও ঠোঁটের পাশে বড় একটা তিল ছিল। ঈশরাত আপুর তিল বিশ হাত দূর থেকেও দেখে বোঝা যেত, ঠিক তোমার মতো। ঠোঁটের পাশে তিল থাকলে নাকি মানুষ অনেক ভালোবাসা পায় শুনেছি। ঈশরাত আপু আমাকে খুব পছন্দ করতো, স্নেহ করতো। আমিও তাকে আমার বড় আপার মতই বা তার চেয়ে একটু বেশিই ভালবাসতাম।
মাঝেমধ্যেই ওনাদের বাড়ির ওদিকে গেলে ডেকে নিয়ে আমার সাথে অনেক কথা বলতো, গল্প শোনাতো। আমি বেশ বুঝতাম সেসব গল্প। ঈশরাত আপুর গল্পের বই পড়ার খুব বাতিক ছিল। এ জন্য অনেক গালমন্দও খেতে দেখেছি। বড়দের গল্পকে খুব সুন্দর করে ছোটদের মতো করে আমাকে শোনাতো, নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলতো কে জানে? মাঝেমধ্যেই আমাকে বাতাসা জাতীয় মিষ্টি খেতে দিত। বড় লক্ষ্মী মেয়ে ছিল ঈশরাত আপু। মাধ্যমিকে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাশ করার পর উচ্চমাধমিকে পড়তো। দ্বিতীয় বর্ষ। ঈশরাত আপুর আব্বার খুব ইচ্ছে এই লক্ষ্মী মেয়েটাকে অনেক দূর পর্যন্ত লেখাপড়া করাবে। অনেক বড় করবে, মেয়েটি বড় চাকরি করবে। ঈশরাত আপু পরিপাটি পোশাক পরে, লাঞ্চবক্স নিয়ে বড় কোনো কোম্পানির অফিসারদের বাসে চড়ে অফিসে যাবে। অফিসার মিস্ ঈশরাত জাহান যখন মাথা উঁচু করে অফিসের বাসে উঠবে, দেখতে কতই না ভালো লাগবে। বুকটা তার গর্বে ভরে উঠবে। একদিন বারান্দার একটা বেঞ্চিতে বসে ঈশরাত আপুর আব্বা বাটিভর্তি মুড়ি পাটাটি গুড় দিয়ে খেতে খেতে ঈশরাত আপুকে বলছিল। আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম ঈশরাত আপুর সাথে সাথে। এও দেখেছিলাম, ঈশরাত আপুর আম্মা গজ-গজ করে রান্নাঘর থেকে কি যেন নেওয়ার জন্য এ ঘরের দিকে আসার পথে বলেছিল বেশকিছু কড়া কড়া কথা। সব মনে নেই, তবে বেশ কিছু কথা এরকম,
বিজ্ঞাপন
‘আফনের এইসব আজব হতা-বাত্তা আমাগো সাইজত ন। মাইয়াডা বিয়ার উপুযুত্তু হইছে। ভালো এ্যাড্ডা পুলা দেইখ্যা বিয়া দিয়া দ্যান ছাই।’
ঈশরাত আপুর মামা বাড়ি অন্য কোনো জেলায়, তাই তার আম্মা এখনও ওইখানকার মতো করেই কথা বলে। দু’একটা কথা বাদে আর সব কথা বুঝতে তেমন অসুবিধা হয় না আমার।
খুব নরম সুরে অনেক আদরের গলায় ঈশরাত আপুর আব্বা বললেন,
’হবে, হবে। বিয়ে-শাদি তো হবেই। এত তাড়াহুড়া করার কি আছে? পড়াশোনা শেষ করুক, তারপর দেখা যাবে।’
বিজ্ঞাপন
বলে মচ্মচ্ করে আনমনে কোনো এক অচিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে মুড়ি চিবোতে লাগলেন। মনে হয় এই মচ্মচ্ শব্দেই আম্মা আরো রেগে গেলেন। গলা আরো চড়িয়ে বললেন,
- ‘নেহা ফরা হিগ্গ্যা আমাগো মাইয়া এক্কেরে জচ ব্যারেস্টার হইবো।’ বলেই মাথা ঝাঁকি দিলেন।
- ’জজ ব্যারিস্টার না হলেও অফিসার হবে। বুঝলে, অফিসার।’
ঈশরাত আপুর মা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ইচ্ছা করেই রান্না-বান্না করার কিছু তৈজস, হাতা বা খুন্তি দিয়ে একটু বেশি শব্দ করে কড়াই বা হাড়িতে নাড়া দিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন,
- ‘আমার এই যে কিলাশ ফাইপ ফাশ কইরাই বিয়া অইলো। আই কি খারাপ আচি নি? নিহা-ফরা হিগ্যা হের কি আর দুইডা বেশি চুক গজইতো?’
ঈশরাত আপুর আব্বা অপলকে চেয়ে থাকে ঈশরাত আপুর দিকে। অনেক আদর আর প্রশান্তি তার চোখে। আম্মা ক্ষান্ত দেয় না। তিরস্কারের সুরে বলে,
- ‘মাইয়া অপিচার হইবো। তাইলেই হইচে। গরীপের আবার ঘুড়া রুগ।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ। শুধু মচ্মচ্ মুড়ি খাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না। সবাই নিশ্চুপ।
ভাবলাম, ঝড় মনে হয় থামল। কিন্তু তা হলো না। নিজেকে নিজে বলার মতোই আম্মা গজ-গজ করলেন,
- ‘ওই পাড়ার মেম্বর ছাব যে ডাক্তর ফুলাডার হম্বন্ধ আইনলো, হেইডাও সাফ্ না কইরা দিলো। ফুলাডা নাহি দ্যাখতে কালা। ডাক্তর মাইন্সের আবার কালা আর ধলা কি? ডাক্তর তো ডাক্তরই। হেরপর আরো কত কি? ফুলা নাহি হাতুইররা ডাক্তর। হেইতো আর হাকিমী, কবিরাজী, ঝাড়ফুক্ কইত্তো ন। ডাক্তর ফুলা। ব্যাবাকে না কইরা দিলো। আমার কপাল!’
ঠাশ ঠাশ দুটো শব্দ এলো। মনে হয় ঈশরাত আপুর আম্মা কপাল চাপড়ালেন। আমার মনে হচ্ছিলো আরও ঝড় আসছে।
কিছু বোঝার আগেই ঈশরাত আপু আমাকে ফিস্ ফিস্ করে বলল, ‘দীপ্ত, তুই এখন বাড়ি যা, কাল বিকালে আসিস্।’
আমি হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়লাম। ফিস্ ফিসি্য়ে বলল, ‘আসিস্ কিন্তু।’
আমি ঘাড় নেড়ে নিঃশব্দে চলে এলাম। আসার পথে খুব মনে হয়েছিল, আচ্ছা, ঘোড়ারোগ কি রোগ? ঘোড়ারোগ হলে কি হয়? গরিবদেরই কি ঘোড়ারোগ হয়? শুনেছি ঘোড়ারা নাকি রাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়। গরিবের ঘোড়ারোগ হলে কি মানুষ বিছানায় আর শুতে পারে না? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়? আবার মনে হয়েছিল ঈশরাত আপুর মনে হয় ওই ডাক্তার ছেলেটার সাথেই বিয়ে হওয়া উচিত ছিল।
ডাক্তার জামাই নিশ্চয়ই ঘোড়ারোগের একটা ওষুধ দিতে পারবে। যদি ঈশরাত আপুর আব্বার ঘোড়ারোগ হয়েই থাকে।
পরদিন বিকেলের পড়া শেষ করে আমি ঈশরাত আপুদের বাড়িতে গেলাম। আপু যেতে বলেছিল, হয়তো বাতাসা দিতে পারেনি ঝগড়াঝাঁটির তাণ্ডবে, তাই ডেকেছে।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিকেল বেলা আমি ঈশরাত আপুদের বাড়িতে ঢুকলাম। উঠান পর্যন্ত এলাম বটে, তবে বেশ ভয়ে ভয়ে। আস্তে আস্তে সন্তর্পণে পা টিপে টিপে হাঁটছিলাম, যেন কোনো শব্দ না হয়। গতকাল যে একটা তাণ্ডব দেখে গিয়েছিলাম, তা কোথায় গড়ালো কে জানে? বুকের মধ্যে একটা ভয় এ জন্য, হয়তো ঈশরাত আপুর মা আমাকে বারবার ওদের বাড়িতে আসতে দেখে ধমকিয়ে বলবে,
‘এই তুই আবার আইছস্?’
ঈশরাত আপুকে আবার ধমকাবে। হয়তো বলবে,
‘তুই এই ফুলাডার লগে কি পুটুস্ পুটুস্ করোচ্? আয় এইহানে, এই থাল-বাসনগুলো ধো। সংসারের এট্টু কামে লাগ’, ইত্যাদি।
নাহ্, আমি ঈশরাত আপু ছাড়া আর কাউকেই ওদের বাড়িতে দেখলাম না। ঈশরাত আপু একা একা বারান্দায় বসে, কাগজ কেটে কি যেন একটা ডিজাইন বানাচ্ছে। আমি আবার ভয়ে ভয়ে ওদের রান্না ঘরের দিকে তাকাতেই ঈশরাত আপু নাক দিয়ে হিস্ হিস্ শব্দ করে হেসে বলল,
- ‘ভয় নেই রে দীপ্ত! সবাই শান্ত হয়েছে। আব্বা বাজারে গেছে। আর আম্মা ওই বাড়ির কাকীর সাথে গল্প করতে গেছে।’
বলেই তার কাগজ কাটায় মনোনিবেশ করল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- ‘এগুলা কি করছো?’
ঈশরাত আপু বলল,
- ‘এটা আমার কলেজের পড়াশোনার ব্যবহারিক কাজ। একে বলে প্রজেক্ট। ড্রয়িং করার মতো, এটা সুন্দর করে বানিয়ে প্রফেসর স্যারের কাছে জমা দিতে হয়।’
আমি ঠিক বুঝলাম না। বললাম,
- ‘পরীক্ষার খাতা জমা দেওয়ার মতো?’
- ’হ্যাঁ, সেরকম। যার প্রজেক্ট বেশি সুন্দর হবে, সে বেশি নম্বর পাবে।’
- ’পরীক্ষার খাতা জমা দিলে আমার স্যারেরা খাতার উপর লাল কালি দিয়ে বড় বড় করে টিক চিহ্ন দেয় বা নম্বর লিখে দেয়। এগুলোর নম্বর কোথায় দেয়? ওই কাঁটা কাগজের উপর কোথাও টুক করে লিখে দেবে?’
- ’তুই তো ভারি চিন্তাবিদ! এজন্যই তো তোর সাথে গল্প করে আমি খুব মজা পাই। আমার স্যারেরা ক্লাসের সবার নামের যে লিস্ট আছে তার মাঝে আমার নামের পাশে একটি নম্বর বসিয়ে দেয়।‘
- ’তুমি জানবে কিভাবে তোমার নম্বর কত?’
- ’সেই কাগজের লিস্টটা সামনের বেঞ্চের কোনায় বসা প্রথমজনকে দেয়। প্রথমজন তার নাম খুঁজে নম্বর দেখে টুকে নেয়। তারপর সে দ্বিতীয়জনকে কাগজটা দেয়। তারপর তৃতীয়জনকে। এমনিভাবে ক্লাসের শেষ বেঞ্চ পর্যন্ত সে কাগজ চলে যায়।’
মনোযোগ দিয়ে শুনে বিষয়টা অনেক ভালো লাগলো বটে।
কিন্তু মনের মধ্যে একটা খচ্ খচ্ অশান্তি বয়ে যাচ্ছিল আমার। বললাম,
- ‘এ তো বেশ সময়ের ব্যাপার। ক্লাশের প্রথম বেঞ্চ থেকে শেষ বেঞ্চ পর্যন্ত যেতেই তো ক্লাশের সময় অনেকটাই পার হয়ে যাবে।’
হেসে ঈশরাত আপু বলেছিল,
- ‘তুই বড় হলে বুদ্ধিজীবী হবি, বুঝলি?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
- ‘বুদ্ধিজীবী কি? তারা কিসের অফিসার? জানি তুমি অনেক পড়ে অফিসার হবে, বড় মাইনে পাবে। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা কোথায় চাকরি করে?’
- ’বুদ্ধিজীবীরা হলো বুদ্ধির ভান্ডার। ওরা বুদ্ধি বেঁচে খায়।’
আমি কিছু না বুঝেই ঈশরাত আপু্র প্রজেক্ট বানানো আর তার কাজের একাগ্রতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম, বড় হয়ে আমিও প্রজেক্ট করব। ঈশরাত আপুর মতো এরকম কাগজ কেটে সুন্দর ডিজাইন বানাবো। আমিও অফিসার হবো, বুদ্ধিজীবী অফিসার।
একসময় ঈশরাত আপুর প্রজেক্ট করা শেষ হলো। সুন্দর একটা ডিজাইন। ঈশরাত আপু ডিজাইনটি হাতের উপরে রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করল। কিছু বুঝলাম, বেশিরভাগই বুঝলাম না। তারপর ওটা ধরে ঘরে রাখতে গেল। ঘরে রেখে হাতের উপর একটা কাগজে করে কয়েকটা চিনির গজা এনে হাসিমুখে আমার হাতে দিলো। গজা আমার খুব পছন্দ। আমি ঈশরাত আপুর শিষ্য হয়ে গেলাম। গজা খেতে খেতে তারপর আমরা এই গল্প, সেই গল্প, এ কথা, সে কথা, কত কি বললাম, শুনলাম। কথার ফাঁকে ঈশরাত আপু আমাকে জিজ্ঞেস করল,
- ‘হ্যাঁ রে দীপ্ত, তুই কি গোপন কথা গোপন রাখতে পারিস?’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
- ‘বারে, গোপন কথা তো গোপনই। তার আর রাখা বা ফেলার কি আছে?’
ঈশরাত আপু উৎসাহের সাথে বলল,
- ‘আছে, আছে। গোপন কথা হলো নিঃশ্বাসের মতো। একবার বুকের মাঝে নিলি মানে আর বের করা যাবে না। বড় নিঃশ্বাস নিয়ে পানিতে ডুব দেওয়ার মতো। দম নিয়ে ধরে থাকতে হবে, ছেড়ে দেওয়া যাবে না। তবেই সেটা গোপন থাকলো, বুঝলি?’
- ’হুম। আমার তো কোনো গোপন কথা নেই। কেউ আমাকে গোপন কথা বলে না।’
- ’আমি তোকে প্রথম একটা গোপন কথা বলব। তোর জীবনের প্রথম গোপন কথা, বুঝলি?’
- ‘আচ্ছা’
- ’দম নিয়ে গোপন কথাটা বুকের মাঝে আটকে রাখতে পারবি?’
- ’পারব।’
বলেই মাথা নেড়ে, বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আমি ঈশরাত আপুকে কথা দিলাম। এবার ঈশরাত আপু এদিক ওদিক সন্তর্পণে তাকিয়ে তার একটা বইয়ের মলাটের ভেতর থেকে একটা খাম বের করে আমাকে দিল। বলল,
- ‘এটা তোর প্যান্টের পকেটে রাখ। সাবধানে রাখিস, দলিয়ে মুচড়িয়ে ফেলিস না। খামের ভিতরে একটা ডিজাইন আছে ভাঁজ করা। ওটা যেন ভাজ করা একটা প্রজেক্ট। ওইরকম।’ বলেই ঘরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সদ্য তৈরি করা প্রজেক্ট ডিজাইনের কথা মনে করিয়ে দিল।
- ’তুই এটাকে ও পাড়ার লোকমান ভাই আছে না, উনাকে দিবি।’
- ’আচ্ছা।’ বলেই আমার একটু মনটা আন্দোলিত হলো। একটু ভয়ও হলো। জিজ্ঞেস করলাম,
- ’লোকমান ভাই যদি বাড়িতে না থাকে? তাহলে কি করব?’
- ’লোকমান ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার দরকার নেই। উনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবি। যদি দেখিস ওনাকে, তবে বলিস যে উনার একটা জিনিস তোর কাছে আছে। খামটা বের করবি না যেন আগেভাগে।’
- ’আচ্ছা।’
আচ্ছা বললাম বটে, কিন্তু ওই শেষ কথাটা, ‘খামটা বের করবি না যেন আগেভাগে’ মনে করে আমার বুকটা দুরু দুরু করে উঠলো।
ঈশরাত আপুকে কথা দিয়েছি। আবার গোপন ব্যাপারটা গোপন রাখতে না পারলেও বেশ একটা ঝামেলা হবে বলে মনে হলো। কিন্তু যে আমাকে এত আদর করে, বসে আমার সাথে কথা বলে, অনেক গল্প করে, তার এটুকু উপকার করতে পারলে ভালোই হবে। তাছাড়া বাতাসা, গজা, দানাদার, গুড়ের পাটালি ইত্যাদি থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছা হলো না। খামটা ধরে উঠে দাঁড়ালাম যাতে আলগোছে পকেটের মধ্যে পেতে দেওয়া যায়। একটুও ভাঁজ না পড়ে। খামটিকে পকেটের মাঝে পুরে, একটু আলতোভাবে হাত বুলালাম ঠিকভাবে পাঁট করে রাখার জন্য। অনুভব করলাম খামটার মধ্যে কিছু একটা নরম দলা পাকানো বা কাগজ ভাঁজ করে ভরে দেওয়া হয়েছে। একটা প্যাটার্ন হাতে অনুভূত হলো। ঈশরাত আপু নিশ্চয়ই আর একটি ডিজাইনের প্রজেক্ট করে লোকমান ভাইকে পাঠাচ্ছে। কিন্তু গোপনে কেন?
ভাবনাটাকে বাদ সাধলো ঈশরাত আপু।
বলল, ‘যা, এখনই যা। তা না হলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। উনাকে হয়তো পাবি না।’
আমি দাঁড়িয়েই ছিলাম। চকিত আদেশ পেয়েই তাড়াতাড়ি রওনা হতেই ঈশরাত আপু হাত নেড়ে বলল,
- ‘সাবধানে যাস। দৌড়ানোর দরকার নেই। সাধারণত যেভাবে হাঁটিস সেভাবে হাঁটবি। যাতে কেউ তোকে থামিয়ে কিছু জিজ্ঞেস না করে, বুঝলি?’
আমি হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বড় রাস্তায় উঠে ওদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঈশরাত আপু ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার খুটি ধরে। তাকিয়ে আছে আমার যাওয়ার দিকে। মনে মনে বললাম, ‘ঈশরাত আপু, আমি তোমার খামটা ঠিক লোকমান ভাইয়ের কাছে পৌঁছে দেব। চিন্তা কোরো না। কোনো এদিক-ওদিক হবে না, দেখো।’
বুকটা আমার তখনও দুরু দুরু করছে। আমি কি দ্রুত হাঁটছি, না আস্তে হাঁটছি তা ঠাহর করতে পারলাম না। সাধারণভাবে হাঁটার গতি নির্দিষ্ট করা আমার জন্য বেশ দুষ্কর হয়ে উঠলো। আমি খুব সাবধানে লোকমান ভাইয়ের বাড়ির দিকে চললাম।
লোকমান ভাইয়ের বাড়ি যেতে গেলে বড় রাস্তা থেকে নেমে পরে একটা সরু মাটির রাস্তা ধরতে হয়। রাস্তাটাকে এক পেয়ে পথ বলা যায়। পথের দু’ধারে বেশ বড় বড় ঘাস আগাছা জন্মেছে। রাস্তার ওপর দিয়ে ভ্যান-রিকশা বা যাতায়াতের ফলে তিনটে সমান্তরাল আর একটু সরু পথ হয়েছে। যেখানে চলাচলের ফলে ঘাস নেই। এই সরু তিনটে পথের মাঝখানের পথে আমি হাঁটতে লাগলাম। মিনিট কয়েক হাঁটার পর, পেছন থেকে সাইকেলের বেল দিতে শুনলাম সাইড দেওয়ার জন্যে। আমি বাম দিকের পথে সরে সাইড দেব না ডানদিকের পথে গিয়ে সাইড দেব, বুঝতে না পেরে এক জায়গায় একটা খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। সাইকেলটি ফুস্ করে আমার বাঁ দিক দিয়ে আমাকে পার হয়ে চলে গেল।
এতক্ষণে বুঝলাম, আমি এপথ দিয়ে আগেও এসেছি, অনেকবারই এসেছি। আর আমি সাধারণভাবে হাঁটছি না। আমার উচিত ছিল, সবচেয়ে বাঁ দিকের পথ দিয়ে হাঁটা। সাইকেলওয়ালারা বাঁ দিক দিয়ে পেছন থেকে এলে, বেল বাজিয়ে বাঁয়ের পথ থেকে পথ পরিবর্তন করে মধ্যের পথ দিয়ে যাবে। এটাই নিয়ম। মনে হলো আমার মাথা পুরোপুরি কাজ করছে না। কোনো ভুলভাল করে না ফেলি। কোনোরকম ভুল করা চলবে না। তাহলে সর্বনাশ হবে। ঈশরাত আপু খুব আশাহত হবে। ভাববে আমি কোনো কাজের না। একদম অকর্মার ঢেঁকি। তাছাড়া আমাকে এরকম একটা দায়িত্ব জীবনে আর কেউ কখনো দেয়নি। যদি ভুল করি তবে আর কোনো দায়িত্বই হয়তো জীবনে কখনো পাব না।
তারপর অতি সাধারণভাবে হেঁটে হাজির হলাম লোকমান ভাইদের বাড়ির সামনে। এতদিন এ পথ দিয়ে কতই যে হেঁটেছি, খেলে বেড়িয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। আজ যেন নতুন করে দেখছি বাড়িটা। মনে হচ্ছে বাড়িটা একদম অচেনা। শুকনো কলাপাতা দিয়ে, বাঁশের চটা দিয়ে, বেড়া দেওয়া হয়েছে। রাস্তার থেকে যেন পুরোপুরি দেখা না যায়, তার জন্য। রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটলে বেড়ার ওপারে কি হচ্ছে খুব একটা বোঝা যায় না, দেখা যায় না। যদি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থেকে পরখ করা হয়, তবেই দেখা সম্ভব একটু আধটু। আমি বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, বাড়ির ভেতরে ঢোকা মনে হয় ঠিক হবে না। বাড়ির ভিতরের উঠানে কাউকেই দেখলাম না। উঠানে শুধু একটা কুকুর শুয়ে বিশ্রাম করছিল বোধ হয়। কুকুরটা আমার গতিবিধি আর ইতস্তত দেখে মুখ তুলল। আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলাম ভয়ে ভয়ে।
কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠলো শোয়া অবস্থাতেই, দাঁড়ালো না। ঘর থেকে লোকমান ভাই বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকালেন। আমাকে দেখতে পাননি মনে হয়। ততক্ষণে কুকুরটা উঠে দাঁড়িয়েছে। আমারও বাড়ির ভিতরে ঢুকতে বেশ ভয় করছিল। এই কুকুরটির ভয়। কুকুর দেখলে আমার খুউব ভয় হয়। কুকুরে কামড়ালে একটা ভীষণ তেষ্টার রোগ হয়। শুনেছি দুই সপ্তাহ ধরে পেটের নাভির চারপাশ দিয়ে প্রতিদিন মোটা সূচের একটা করে ইঞ্জেকশান দিতে হয়। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! তারপর দেখলাম কুকুরটা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার লোকমান ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। লোকমান ভাই রাস্তার দিকে এলেন।
বললেন, ‘কিরে ভয় পেয়েছিস?’
ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, অল্প।’
আমাকে আশ্বস্ত করে লোকমান ভাই বললেন,
- ‘ভয় নেই রে। আমি সাথে থাকলে টমি তোকে কিছু বলবে না। ওর নাম টমি।’ বলেই টমির মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলেন।
টমি আনন্দে লেজ নাড়ছে। মনে হচ্ছিল, বেশ মজা পেয়েছে আমাকে দেখে। সে আস্তে আস্তে খুব কাছে এসে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে আমার হাফ্প্যান্টের ডান পকেটে মুখ ঘষতে লাগলো। খুব অবাক আর ভয়ে আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম।
- ’তোর নাম দীপ্ত না?’ লোকমান ভাই জিজ্ঞেস করলেন।
- ’হ্যাঁ।’
- ’কিরে কিছু বলবি?’
- ’হ্যাঁ।’
- ’বল্’
- ’এখানে বলা যাবে না। আপনার একটা জিনিস আছে আমার কাছে। ঈশরাত আপু পাঠিয়েছে।’ বলেই ডান পকেটের উপরে হাত দিলাম।
- ’আচ্ছা। তুই বড় রাস্তার দিকে যা। ফিরতি পথের দিকে হাট। আমি আসছি।’
বলেই আঙ্গুল নির্দেশ করে যেদিক দিয়ে এসেছিলাম সেদিকটা দেখিয়ে দিলেন।
আমি ওদিকে হাঁটা শুরু করলাম। কয়েক মিনিট পরই সাইকেলের আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি লোকমান ভাই সাইকেল চেপে প্রায় আমার কাছে চলে এসেছেন। কাছে এসেই সাইকেল থেকে নেমে আমার সাথে সমান তালে হাঁটা শুরু করলেন লোকমান ভাই। আমি বাঁ পাশের পথ ধরে আর লোকমান ভাই মাঝের পথ ধরে সাইকেল ঠেলে ঠেলে আমার সাথে সাথে হাঁটছেন।
লোকমান ভাই জিজ্ঞেস করলেন,
- ‘কিরে, কি জিনিস আছে তোর কাছে?’
আমি সামনে-পেছনে, বামে-ডানে একটু তাকিয়ে সাবধানে পকেট থেকে খামটা বের করে লোকমান ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। বললাম,
- ‘এই যে এটা। ঈশরাত আপু দিয়েছে আপনাকে দিতে।’
- ’ও আচ্ছা।’
বলেই আমার মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে ক্ষণিকের মধ্যে খামটি আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে জিন্সের প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে দিলেন। তারপর বললেন,
- ‘তুই কি আমার সাইকেলে চড়ে ওদিকে যাবি?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
- ‘না, ঠিক আছে। আমি ফুটবল মাঠে যাব। এই তো বেশি দূরে না, হেঁটেই যেতে পারব।’
পকেট থেকে চিঠিটা পৌঁছে দিয়ে যে নিষ্কৃতি পেয়েছি, এটাই অনেক। ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলেনি। অন্য কেউ টের পেলেই আমাকে প্রশ্ন করত। এমনকি টমিও টের পেয়েছে। সে ঠিক আমার ডান পকেটের কাছে নাক দিয়ে শুঁকে মুখ ঘষছিলো। ও ঠিকই বুঝেছে। পশুপাখীরা অনেক বোঝে। সেদিন ঈশরাত আপু তার বিজ্ঞান বইয়ে কুকুর নিয়ে পড়ছিল আর আমাকে তরজমা করে শোনাচ্ছিল। ইউরোপ আমেরিকায় নাকি অন্ধ লোকেরা কুকুর নিয়ে চলাফেরা করে। ওই কুকুরদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কুকুর তার অন্ধ মালিককে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে। একটি কুকুরের ঘ্রাণশক্তি নাকি মানুষের তুলনায় দশ হাজার থেকে এক লক্ষ গুণ বেশি তীব্র। টমি নিশ্চয়ই আগেও ঈশরাত আপুর চিঠি শুঁকেছে। তাই মনে হয় সে আমার সাথে উচ্চবাচ্য করলো না, বন্ধুর মতো আচরণ করলো। ভালো আর পছন্দের ঘ্রাণ নাকি কুকুরেরা নাকের ডান ছিদ্র দিয়ে শুঁকে। কুকুরেরা নাকি এক দেড় মাইল দূর থেকেও গন্ধ বুঝতে পারে।
মনে হলো, ঈশরাত আপুর খামটা আমার রক্ষাকবজের মতো কাজ করেছে। এখন ভালোমতো ফুটবল মাঠে যেতে পারলেই বাঁচি।
লোকমান ভাই বললেন, ‘আচ্ছা, সেটাই ভালো হবে।’ বলেই সাইকেল চালাতে শুরু করতে গিয়েও এক পা দিয়ে ভর করে সাইকেলের ওপরে বসে বললেন,
- ‘এর পরেরবার এলে তোকে কদমা খাওয়াবো। নন্দ সাহার তৈরি মজাদার কদমা।’
আমি ‘আচ্ছা’ বলে ঘাড় নাড়লাম। লোকমান ভাই চোখের পলকে দ্রুতগতিতে বড় রাস্তার দিকে হুড়মুড় করে তার সাইকেল চালিয়ে চলে গেলেন, যেন তার ভীষণ তাড়া আছে।
বিরহের কথা সে লিখে পাঠাল (পর্ব-০১)
বিরহের কথা সে লিখে পাঠাল (পর্ব-০২)
লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক, বোকা রেটন, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র
Email: [email protected]