বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০২৫, ঢাকা

বিরহের কথা সে লিখে পাঠাল (পর্ব-০২)

অমিয় দাশ
প্রকাশিত: ২৭ মে ২০২৪, ০৫:৩০ পিএম

শেয়ার করুন:

বিরহের কথা সে লিখে পাঠাল (পর্ব-০২)

দীপ্ত তার ল্যাপটপ খুলে গুগল ডকে তার চিঠি লেখা আর চিঠিটি ডাকযোগে পাঠানোর ঘটনাপ্রবাহ লেখা শুরু করলো। ফাইলটির নাম দিলো ‘তোমার অভিমান ভাঙাতে…’। সে লিখলো—

প্রিয় দোয়েল পাখি,


বিজ্ঞাপন


তোমাকে লিখবো বলেছিলাম। তুমিও চেয়েছিলে যেন তোমাকে একটা চিঠি লিখি। কাগজের ওপর, কলম দিয়ে হাতের লেখা চিঠি। সময়ের সাথে সাথে হাতে চিঠি লেখাটাই মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশে, মানে ক্লাউডে! সেটা তোমাকে চিঠি লিখতে গিয়ে খুব অনুভব করেছি আমি। তোমাকে একটা খুব সাদামাঠা করে লিখেছি বটে, কিন্তু তার যে প্রস্তুতি আর ঘটনাপ্রবাহ, তার যে উত্তেজনা, সেটার অনেকটাই বাকি রয়ে যাবে যদি তোমাকে সেগুলো না বলি। চিঠি লিখতে গিয়ে যা যা করলাম, তার সাথে ভাবনাটাও তো গুরুত্বপূর্ণ আর বলা আবশ্যিক, তাই না? এই যেমন ধরো, চিঠি লিখে সুন্দর করে ভাঁজ করতে হবে, সে ভাঁজটাও দুই ভাঁজ, তিন ভাঁজ, নয় তো চার ভাঁজ। আবার মনে হলো সুন্দর করে জাপানি ধাঁচে অরিগামী করে চিঠিটাকে একটা গোলাপ ফুল কিংবা একটা প্রজাপতির মতো বানাতে হবে।

মনে হয়েছিলো, কাছে যদি খেজুরের রসের ঘ্রাণ বোতলে ভরা থাকতো, তবে তা একটুখানি চিঠিটাতে মাখিয়ে দিলে তুমি সে ঘ্রাণ নাকের কাছে নিয়ে, একদম চোখ বুজে, শুঁকতে আর হয়তো ভাবতে, আমাদের পরিচয় হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরের কথা। মনে আছে? একটু ভালো করে পরিচয় হওয়ার পর থেকেই আমরা নদীর ধারের চিকন পথ ধরে একসাথে হাঁটতাম? যেখানে অনেক খেজুর গাছ ছিল। সেখানে রসের ভাঁড় ঝোলানো থাকত বেশকিছু খেজুর গাছে। খেজুরের কাঁটাওয়ালা বাইগো বা ডাল খণ্ড খণ্ড করে ভাঁড়ের মুখে খানিকটা বের করে ঢোকানো থাকতো। যেন কাঠবিড়ালী বা পাখি-পক্ষী ভাঁড়ের কানায় বসতে না পারে বা ভাঁড়ের মধ্যে ঢুকে রস নষ্ট না করে। বাতাসে মৌ মৌ করতো খেজুরের রসের মৃদু ঘ্রাণ।

আমি আর তুমি কতই না ওই সব পথে হেঁটেছি। নদীর পাড়ে দুটো খেজুর গাছ নদীর ধার ঘেঁষে নুইয়ে ঝুলে ছিল। আমরা সেই খেজুর গাছ দুটোর একটির উপর পা ঝুলিয়ে বসে কত আগডুম বাগডুম কথাই না বলেছি। কখনো মনেই হয়নি যে একদিন এত স্মৃতিময় মধুর হবে সে হাওয়া। আজ খুব টের পাই, মিস করছি সেই পথগুলো, সেই হাওয়া, সর্বোপরি তোমাকে। যদি সে ঘ্রাণ মাখিয়ে দিতে পারতাম, তুমি আলতো করে যখন নাকের ডগায় চিঠিটাকে ছোঁয়াতে, তখন আমার হাতের এই স্পর্শ তোমার গালে, ঠোঁটে এমনিতেই লাগতো। এটাও তো একরকম আদর, আর ভালোবাসার ছোঁয়া।

কিন্তু দ্যাখো, এখন কি হয়েছে। লিখেছি বটে, তবে মনের মতো করে ছোঁয়া পাঠাতে পারিনি। ঠিকানা লিখেছি খামের ওপর সুন্দর করে, যেন তুমি বুঝতে পারো কতই না যত্ন করে তোমাকে লিখেছি। তারপর অরিগামীর ভাঁজের চিঠিটা খামে পুরে, জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে, খাম বন্ধ করেছি। পানি দিয়ে নয়, জিহ্বার লালা দিয়ে! যেন আমার শরীরের দু’একটা অনুকোষ তোমার কাছে পৌঁছায়। আমি না পৌঁছাতে পারলেও আমার একটা-দুটা ডিএনএ তোমার সাথে থাকলে মনে হবে আমি আছি তোমার বালিশের নিচে, সিন্দুকে অনেকদিন, কিংবা ওয়েস্ট বাস্কেটে অল্প কিছুক্ষণের জন্য। সে যাই হোক, আছি তো। শুনেছি যত্নে থাকলে ডিএনএ নাকি অনেকদিন বাঁচে।


বিজ্ঞাপন


তারপর জানো কি হয়েছে? আমি সময় করে পোস্ট অফিসে গেলাম। অলস পোস্টমাস্টারের কাছ থেকে স্ট্যাম্প কেনার জন্যে পোস্ট অফিসে লাইনে দাঁড়ালাম। লাইনে আট-দশজন লোকের পেছনে আমি দাঁড়িয়ে। কারও কাছে কোনো চিঠির খাম দেখলাম না। প্রায় সবার হাতেই কম বেশি নগদ টাকার গোছা, বান্ডিল দেখলাম। লোকজন কি কাড়িকাড়ি টাকা নিয়ে এসেছে আমার মতোই স্ট্যাম্প কিনতে? নিজেকে আর একা মনে হলো না। দেখলাম সামনের লোকজন কেউই স্ট্যাম্প কিনল না। কেউ টাকা জমা দিলো, কেউবা টাকা তুলল, গুনে গুনে হিসাব করে নিলো। এতক্ষণে আমি বুঝতে পারলাম, পোস্টঅফিস এখন আর পোস্ট অফিস নেই। ‘পয়সা অফিস’ হয়ে গিয়েছে। টাকা পয়সা ওঠানো, রাখা, লগ্নি করা ইত্যাদি কাজ চলছে ওখানে। কাউকে কেউ মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাচ্ছে না। এখন ব্যাংক আর পোস্ট অফিসের মাঝে তেমন কোনো তফাৎ নেই বললেই চলে। প্রায় আশাহত ভঙ্গিতে ডাকটিকিট আছে কিনা জিজ্ঞেস করলাম বিজ্ঞ চেহারার পোস্টমাস্টার লোকটিকে। আমাকে বেশ পরখ করে দেখে নিয়ে একটা ড্রয়ার হাতড়ে একটা ময়লা পুরনো খাতা বের করে জিজ্ঞেস করলো,

- ‘চিঠি কি দেশের ভিতরে, না বিদেশে যাবে?’

আমি খামটা একটু উচিয়ে দেখিয়ে বললাম,
- ’দেশের ভেতরে।’

- ’ও’, বলেই একটা ডাকটিকিট এগিয়ে দিয়ে বিরক্তির সুরে বলল, ‘৫ টাকা খুচরা আছে? আমার কাছে খুচরা নেই।’

আমি আমার সঞ্চয় করা টাকা নিয়ে চিঠি পোস্ট করতে গেছি। সবই খুচরা টাকা, কয়েন, ইত্যাদি আমার পকেটে। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। পোস্টমাস্টার একটা ডাকটিকিট এগিয়ে দিলেন। ডাকটিকিটটা দেখে আমার ঠিক পছন্দ হলো না। কি সব হিজিবিজি, কিসের একটা ফটো যেন। ছাপানোটাও পরিষ্কার হয়নি। ওই ডাকটিকিটের দাম অর্ধেক হওয়া উচিৎ। দামাদামি করার এখতিয়ার থাকলে ঠিক জিগ্যেস করতাম যে অর্ধেক দামে ওই ডাকটিকিট আমার কাছে বিক্রি করবে কিনা। তোমার কাছে আমি জীবনের প্রথম চিঠি লিখছি। মনে রাখার মতো আর্টিস্টিক একটা ডাকটিকিট আঁটাতে হবে খামের ওপর, যাতে ওটা দেখেই তোমার মন ভালো হয়ে যায়!

আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- ‘অন্য কোনো ভালো, আরও ভালো ডিজাইনের স্টাম্প আছে স্যার?’

নিরাশ ভঙ্গিতে নাকের ওপর ঝুলে থাকা চশমার ফাঁক দিয়ে মাথা উচু না করেই পোস্টমাস্টার বললো,

- ‘ওই তো হলো। ওটা লাগালেই সঠিক জায়গায় চলে যাবে। একটুও নড়চড় হবে না। শুধু ঠিকানাটা ঠিক থাকলেই চলবে।’

তবুও মনটা চাইছে একটা শাপলা ফুল কোনো স্তব্ধ লেকে ভেসে আছে বিন্দু বিন্দু ঘামের মতো শিশির গালে নিয়ে, এরকম ছবিওয়ালা একটা ডাকটিকেট। নয়তো একটা সাদা ধবধবে বলাকা গলাটা একদম সামনে বাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে, যেন দূর থেকে, অনেক ওপর থেকে তোমাকে দেখতে পাচ্ছে, এরকম একটা স্ট্যাম্প পেলে ভালো হতো। বললাম,

- ‘তবুও দেখুন না একটু স্যার।’

আমার আকুতি হয়তো তিনি বুঝতে পারলেন। বললো,

- ‘এই যে দ্যাখো। আর এই একরকম আছে। একটা খালি গায়ে গাড়িয়াল, তার কাদায় আটকে থাকা গরুর গাড়ির চাকা ধরে ঠেলে কাদা থেকে গাড়িটাকে সামনে আগানোর চেষ্টা করছে।’

বলেই শুধু হাত গলানো যায় এরকম জং ধরা লোহার গ্রিলের ফুঁটো দিয়ে একটা স্ট্যাম্প এগিয়ে দিলো আমার সামনে। বললাম,

‘হয়েছে, বেশ পছন্দ হয়েছে।’

হেসে সঞ্চয় করা টিফিনের পয়সার থেকে দাম শোধ করে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ ডাকটিকিটটার দিকে। ভাবলাম, আচ্ছা এই গরুর গাড়ি, গরু, গাড়িয়াল— এসবের মধ্যে কোনটা আমি? কাদা, গরুর গাড়ি, নাকি গাড়িয়াল?

পোস্টমাস্টার বললেন,

- ‘স্ট্যাম্পটা খামে লাগিয়ে আমার কাছে দিতে পারো, আমি এখানেই ওই ডাকের বস্তায় দিয়ে দেব। ঠিক চলে যাবে। ঠিকানা লেখা হয়েছে? ঠিকানা লেখা না হলে, ঠিকানা লিখে ওই লাল ডাকবাক্সেও ফেলতে পারো।’

আমি ইতস্তত করে বললাম,

- ‘না, হ্যাঁ, ঠিকানা লেখা হয়েছে। আর একটু দেখে নিই।’

বলেই ফুঁটোর কাছ থেকে সরে এলাম। তোমার কাছে এ চিঠি যাবে, কত হৃদয়ের মাধুরী, আমার ডিএনএ মিশিয়ে লিখেছি চিঠিটি। এ ভালোবাসা ওই বস্তায় এখনই ভরতে মন সায় দিচ্ছিলো না। এ চিঠি আমি আস্তে করে আলগোছে ওই জবা ফুলের মতো টকটকে লাল ডাকবাক্সে রাখবো। যাতে আমার প্রতিটি ডিএনএ দম বন্ধ হয়ে না যায়। চিঠিটা পরে তো বস্তায় ভরবেই। সে ঠিক আছে। তাছাড়া মনে সন্দেহ হলো, পোস্টমাস্টারের হাতে খামটা দিলেই হয়তো সে পরখ করে তোমার ঠিকানা দেখবে। তোমার ঠিকানা দেখবে চশমার ভেতর দিয়ে, তারপর চশমার বাইরে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করবে,

- ’কে হয়?’

আমি তখন কি বলবো? আমার কে হয়? তাই তো, আসলে তুমি আমার কে হও গো?

আমি তো কিছুই বলতে পারব না। শুধু বুকের মাঝে একটা ধক্-ধক্, ধক্-ধক্ শব্দ হবে। গলার শব্দ নিঃশব্দ হয়ে যাবে। জানো, এসব জায়গায় আমি কিচ্ছু বলতে পারি না। আমাকে প্রকাশ করতে পারি না। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় বরফের মতো জমে যায়। পরে সেই বরফ গলে বটে, কিন্তু ততক্ষণে হয়তো দৃশ্যপঠই পরিবর্তন হয়ে গেছে।

পোস্টমাস্টার আমার নীরবতা দেখে আরও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

- ’আত্মীয়?’

আমি বললাম,

- ‘হ্যাঁ।’

বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল যে, ‘আমরা আর জন্মে সাথী ছিলাম। আমার পরম আত্মার আত্মীয়।’

তা কি আর বলা যায়? এটা বললেই পোস্টমাস্টার হয়তো আমাকে পাগল বলে পরে চিঠিটা ঠিক খুলে পড়বে। পড়ে হয়তো অনেক হাসাহাসি করবে। আর গন্তব্যে পাঠাবেই না। একবার খাম খুললে সে তার অপরাধবোধবশতঃই পাঠাবে না, এটা একদম নিশ্চিত।

না থাক, তাই ভেবে ওখান থেকে সরে এলাম।

আমি বললাম,

- ‘আচ্ছা, ঠিকানা চেক করে দেখে লাল ডাকবাক্সে ফেলব।’

চিঠিটা ঠিকমতো বন্ধ হয়েছে তো? আবার একটু হাত, চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। চিঠিটা আবার ভালো করে দেখে নিলাম। কোনোরকম ভুলভ্রান্তি হওয়া চলবে না। ভুল হলেই এই খামটা ভর্তি অনেক কথা তোমার কাছে পৌঁছুবেই না। হারিয়ে যাবে। কোথায় হারিয়ে যাবে তাও জানি না। হয়তো নিরুদ্দেশের চিঠিগুলোর মতন পোস্টমাস্টার কেজি দরে ওই পুরনো বই-কাগজ কেনার ফেরিওয়ালাদের কাছে বিক্রি করে দেবে। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে হাতবদল হয়ে গ্রামের হাটের ওই চানাচুর, ছোলা বা বারোভাজার দোকানদারের কাছে চলে যাবে। আমার চিঠি হয়ে যাবে একটা বারোভাজা খাওয়ার খিলি পাত্র। আমার চিঠি তোমার পরিবর্তে দেখবে তৃপ্তি করে খাওয়া কোনো কিশোর-কিশোরীর, কিংবা লোকের তৃপ্তিতে ভরা মুখ। চিঠিটা হয়তো ভাববে, কি এসে যায়? কারও একটু হাসিমুখ তো দেখতে পেয়েছে, সেটাই কম কি? সবাই কি আর সবার মনে হাসি ফোটাতে পারে বলো? তারপর চিঠিটাকে কি করবে কে জানে? হয়তো আমার আঁকা দোয়েল পাখির ছবিটা দেখে সন্দিহান হয়ে কাগজটা পড়ে দেখবে। ভাববে কতই না মনের আকুতি লুকিয়ে আছে এই চিঠিতে। হয়তোবা ভাববে, বিশাল একটা ঢং!

চিঠিটি লেখা হয়েছে তোমাকে আমার দেওয়া ছদ্ম নাম ‘দোয়েল পাখী’কে উদ্দেশ্য করে। তুমি যে নামে গোপনে আমাকে ডাকো, সে নামটা লিখেছি একদম শেষে। লিখেছি, ‘ইতি, শুধু তোমার, বাবুই’, তোমার দেওয়া সেই গোপন নামটা। জানো, তোমার দেওয়া ওই ‘বাবুই’ নামটা আমি অনেক অনেক ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। আমি চাই না এ জীবনে আর কেউ আমাকে ওই নামে ডাকুক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
‘নামেই কিবা আসে যায়,
যে নামে ইচ্ছা
সে নামে ডাকিও আমায়।’

কবি যাই বলুক না কেন, তোমার দেওয়া ‘বাবুই’ নামে তুমিই শুধু আমাকে ডাকবে। তোমারই শুধু অধিকার আছে আমাকে ওই নামে ডাকার। পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে যে নামে খুশি ডাকুক, আমি শুধু ওই নামটা তোমার কাছ থেকেই, তোমার কণ্ঠেই শুনতে চাই। এটা কি খুব বেশি চাওয়া বলো? আমি তো প্রকৃতির কাছে, কারো কাছে টাকা পয়সা, কোনো মূল্যবান জিনিস কিছুই চাইছি না। শুধু ওই নামটা, এই তো।

জানো, চিঠিটা খামে ঢুকিয়ে, খামটা বন্ধ করার পর মনে হলো, একটা ভুল হয়ে গেছে। সেদিন একটা গল্প পড়ছিলাম জগৎ বিখ্যাত যোদ্ধা ও ফ্রান্সের রাজা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সম্বন্ধে। অনেক কিছুই করেছেন নেপোলিয়ন তার জীবনে। কিন্তু তার একটা বিশেষ বিষয় আমার খুব মনে ধরেছে। তার স্ত্রী জোসেফিনকে সে চিঠি লিখতো যুদ্ধে থাকা অবস্থায়ও। সে ছিল খুব সাহসী যোদ্ধা। ফ্রান্সকে সে যেকোনো আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। অনেক বিজয় ছিল তার ঝুলিতে। একবার নেপোলিয়ন একটা যুদ্ধে হেরে যায়। সবাই কি আর সব সময় জেতে বলো? জয়-পরাজয় নিয়েই তো আমাদের জীবন। তারপর তাকে বেশকিছু রক্ষীসহ একটি বিরান দ্বীপে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। স্ত্রীকে সে সাথে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু অনুমতি মেলেনি। সব বিজয়ের যত আনন্দ ছিল তার জীবনে, স্ত্রী-বিরহের দুঃখ তাকে তারচেয়েও বেশি দুঃখ ভারাক্রান্ত করেছিল। সে তার নিজের জীবনের চেয়েও তার স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতো।

তারও আগে একবার ইটালিয়ানদের সাথে যুদ্ধ বাঁধলো নেপোলিয়ন বাহিনীর। সে এক ভীষণ ভয়াবহ যুদ্ধ। যুদ্ধ ময়দানে তার সাথে হাজারো সেনা থাকলেও, সেই বিরান প্রান্তরে তার খুব একা আর নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, এমন যদি হতো যে, তার স্ত্রী জোসেফিন যুদ্ধক্ষেত্রে তার সাথে আছে। তাহলে অতি সহজেই সে মনে হয় যুদ্ধে জয় আনতে পারবে। কি অদ্ভূত ভাবনা, তাই না? যুদ্ধক্ষেত্রে আবার কেউ তার স্ত্রীকে নিয়ে যায় নাকি? এ তো আর মধুচন্দ্রিমা না! এ হলো জীবন-মৃত্যুর খেলা। সেখানে ভয় করলে বা বেখেয়াল হলেই মৃত্যু অনিবার্য। এমন খেলা যে, হয় মারবে, নয় মরবে। তবুও নেপোলিয়ন যুদ্ধের মাঝে বিশ্রাম বা ঘুমের যে একটু সময় পেতো, তখনই সে তার স্ত্রীকে চিঠি লিখতন। অনেক ভালোবাসায় মোড়া সে চিঠিগুলো।

এই তো সেদিন খবরে দেখলাম, নেপোলিয়নের লেখা একটি চিঠি কোনো এক সংগ্রাহক ৫ লক্ষ ইউরোতে বিক্রি করেছে অন্য কোনো এক সংগ্রাহকের কাছে। টাকায় হিসেব করলে আজকের দরে সেটা ছয় কোটি টাকার একটু বেশি, আর রুপিতে প্রায় সাড়ে চার কোটি রুপি। বিরাট এক নিলাম হাউস চিঠিটা নিলামে তুলেছিলো।

সে যাকগে, ভালোবাসা বিক্রি হোক, আর চিঠি বিক্রি হোক, তাতে কার কিইবা এসে যায়? যে বিশেষ ব্যাপারটা আমার মনে ধরেছে তা হলো, নেপোলিয়ন তার স্ত্রীকে চিঠি লেখা শেষ হলে তার ঘাড়ের ঘর্মাক্ত এলাকায় চিঠিটা বারকয়েক ঘষে ঘাম লাগাতেন। তারপর চিঠিটা খামে পুরে, ভালোমতো খাম বন্ধ করে, পাঠাতো তার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে। জোসেফিনও জানতো ব্যাপারটা। চিঠি পেলেই সে চিঠিটাকে কি করতো তা তো বুঝতেই পারছ। জোসেফিন চোখ বন্ধ করে, চিঠিটাকে তার নাকের কাছে এনে প্রাণভরে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর গায়ের ঘ্রাণ নিতো। তারপর চিঠিটা পড়তো। নেপোলিয়ন কেন এরকম করতো তা কারো জানা নেই। কেউ কেউ এটাকে অত্যাধিক ভালোবাসা, আবার কেউ কেউ এটাকে নিরাপত্তা হিসেবে মনে করতো। রাজার চিঠি বলে কথা! হাতের লেখা নকল করে যদি কেউ উল্টোপাল্টা লিখে জোসেফিনকে পাঠায়, কিংবা শত্রুপক্ষ যদি সুবিধা নেওয়ার জন্য, কৌশলে ক্ষতি করার জন্য কোনো চিঠি পাঠায় তাহলে? হাতের লেখা নকল করতে পারলেও গায়ের ঘ্রাণ তো আর নকল করতে পারবে না, বলো? আর সেটা তো নেপোলিয়ন ব্র্যান্ডের ঘ্রাণ! জোসেফিনও চিঠির গন্ধ শুঁকেই যাচাই করতে পারত যে এটা তার প্রাণপ্রিয় স্বামীর পাঠানো চিঠি কিনা।

তোমাকে লেখা চিঠির খাম বন্ধ করার পর মনে হয়েছিল যে আমিও নেপোলিয়নের মতো করে আমার ঘাড়ের ঘাম মাখিয়ে তোমাকে চিঠি লিখলে কেমন হতো? ততক্ষণে চিঠির খামটা বন্ধ করেছি। ততক্ষণে চিঠির খামের আঠা তার কাজ ঠিকমতোই করে ফেলেছে। খামটা খুলতে গেলেই হয়তো ছিড়ে যাবে পেছনের ফ্ল্যাপটা। অনেক সময় আঠা শুকালে, জোড়া দেওয়া জায়গাটা শক্ত কড়কড়ে হয়ে আলাদা হয়ে যায়। লক্ষ্য করে দেখলাম তা হয়নি। ইচ্ছে আছে আগামী চিঠিতে তোমাকে আমার ভালোবাসার ঘ্রাণ পাঠাবো। আরেকটা জিনিসও করতে পারি। একদিন তোমাকে একটা ম্যাজিক চিঠি পাঠাবো। চিঠিটি হবে এরকম যে, সাধারণভাবে তুমি লেখাগুলো কিছুই দেখতে বা পড়তে পারবে না। চিঠিটা যখন পানিতে ভেজাবে, শুধুমাত্র তখনি সব লেখা ফুটে উঠবে, সব রঙের কাজ তুমি দেখতে পাবে।

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক, বোকা রেটন, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র
Email: [email protected]

বিরহের কথা সে লিখে পাঠাল (পর্ব-০১)

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর