সপ্তমবারের মতো ভাঙনের মুখে পড়েছে জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতাদের সিংহভাগ একট্টা হয়েছেন। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোটভাই জিএম কাদেরের নেতৃত্ব। আগামী ২৮ জুন বিরোধীরা কাউন্সিলে অনড় থাকায় মহাদুশ্চিন্তায় পড়েন জাপা চেয়ারম্যান। তবে শেষ পর্যন্ত হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন তিনি। আপাতত বিরোধীরা কিছুটা পিছুটান দিয়েছেন। আগামী শনিবার তারা কাউন্সিল করছেন না। তবে জিএম কাদের নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জের মুখেই রয়েছেন। কাউন্সিল আয়োজনে তাকে আলটিমেটাম দিয়েছেন নেতারা। না হলে চেয়ারম্যানকে ছাড়াই কাউন্সিল করবেন তারা।
বুধবার (২৫ জুন) দলের কো-চেয়ারম্যান ও বিরোধী বলয়ের প্রধান নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা সংঘাত চাই না। চীন মৈত্রীর বরাদ্দ বাতিলের পর কাকরাইলে কাউন্সিল করার চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু সেখানে তারা (জিএম কাদের) সমাবেশ আহ্বান করেছে। আমরা যদি কাউন্সিল করি তাহলে সমস্যা হবে। কারণ জাতীয় পার্টির নামে তো অনেক বদনাম আছে। নতুন করে সমস্যা হতে পারে। তাই আপাতত কাউন্সিল করছি না আমরা। আমরা দ্রুত চেয়ারম্যানকে কাউন্সিলের জন্য বলেছি। আহ্বানে সাড়া না দিলে সুবিধামতো সময়ে কাউন্সিল করবো।’
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ২৮ জুন দলের জাতীয় সম্মেলন ঘোষণা দেন জিএম কাদের। এর মধ্যেই জাপায় নতুন নেতৃত্ব গড়ার উদ্যোগ নেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশির ভাগ সদস্য। বিশেষ করে কাউন্সিলে চেয়ারম্যান হিসেবে কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব পদপ্রত্যাশী বলে জানালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে জিএম কাদেরের কপালে।
এমন পরিস্থিতিতে ভ্যেনু জটিলতার কথা বলে ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত করেন জিএম কাদের। অথচ নিজেই এই তারিখ ঘোষণা করেছিলেন। গত ১৬ জুন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জাতীয় পার্টির দশম জাতীয় সম্মেলনের জন্য বরাদ্দ পাওয়া বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ হল বরাদ্দ বাতিল করায় ২৮ জুন সম্মেলন হচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে স্থান পাওয়াসাপেক্ষে জাতীয় সম্মেলনের তারিখ ও সময় জানিয়ে দেওয়া হবে।
তবে চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারদের পক্ষ থেকে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইলে সম্মেলন করার দাবি করেন। প্রয়োজনে চেয়ারম্যান ছাড়াই কাউন্সিলের ব্যাপারে তারা অনড় থাকেন। তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় নেতাদের সিংহভাগ। এমনকি জিএম কাদেরের সহযোগী হিসেবে পরিচিত জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। পাশাপাশি রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এই অংশটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার আলোচনা হয়।
বিজ্ঞাপন
কাউন্সিল ঠেকাতে জিএম কাদেরের অনুসারীরা ২৮ জুন দলীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের ঘোষণা দেন। মূলত এতেই বিরোধীরা আপাতত ক্ষান্ত হন। সংঘাত এড়াতে আপাতত কাউন্সিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ঢাকা মেইলকে জানান বিরোধী বলয়ের প্রধান নেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তবে দ্রুত কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণার ব্যাপারে অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
কী বলছেন জাপা নেতারা
জিএম কাদেরপন্থীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতারা মিলে আলাদা প্লাটফর্ম করলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গেই থাকবেন। তাদের ভাষ্য, আগেও যতবার দলে ভাঙন ধরেছে তখনও তৃণমূল মূলধারার সঙ্গেই ছিল। এর বাইরে যারা রাজনীতিতে খুব একটা ভালো করতে পারেননি। এবারও এমন পরিস্থিতি হলে সারাদেশের নেতাকর্মীদের জিএম কাদেরের সঙ্গেই পাবেন।
দলের কো-চেয়ারম্যান ও রংপুরের সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘দলে অস্থিরতা তো অনেক আগে থেকেই আছে। জাপা তো আর কম ভাঙেনি। অনেকে চেষ্টা করতেছে, কিন্তু মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে কোনো লাভ নেই। জিএম কাদেরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। চেয়ারম্যান আমাদের ঢাকায় ডেকেছেন। সব জেলা ও মহানগরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে সামনে কী হবে তার পরামর্শ দেওয়া হবে।’
এদিকে জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে সম্মেলনের সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে আসা হয়েছে। এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান সেই সিদ্ধান্তেই অটল আছেন। আপাতত সম্মেলন হচ্ছে না এটাই চূড়ান্ত।’
আরও পড়ুন
জি এম কাদেরের বাসভবনে হামলা: জাতীয় পার্টি-এনসিপির পাল্টাপাল্টি মামলা
জাতীয় পার্টিকে ‘আ.লীগের দালাল’ আখ্যা দিয়ে আরও যা বললেন আখতার
এদিকে গত ১৭ জুন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের যৌথ বিবৃতিতে হল বিকল্প স্থান হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে কাউন্সিল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে বুধবার (২৫ জুন) এক বিবৃতিতে তারা নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা নমনীয় হয়ে দ্রুত কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করতে জিএম কাদেরের প্রতি আহ্বান জানান।
জাপার একজন প্রভাবশালী নেতা মঙ্গলবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমাকে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ডেকেছিলেন। গিয়ে দেখলাম জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠরা সবাই সেখানে। দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে রংপুরের মোস্তফা আর শামীম হায়দার পাটোয়ারী ছাড়া শীর্ষ নেতাদের কেউ জিএম কাদেরের সঙ্গে নেই। কাউন্সিল করে নতুন কমিটি হলে তো জিএম কাদের মাইনাস হয়ে যাবেন।’
সপ্তমবারের মতো ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে জাপা!
নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। দ্বিতীয় দফার ভাঙন হয় ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে। কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফা এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মতো ভাঙন ধরে।
এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল তার স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়। এবারও জিএম কাদের সম্মেলন ডাকতে গড়িমসি করলে সপ্তমবারের মতো দল ভাঙনের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যে কারণে জিএম কাদেরকে মাইনাসের চিন্তা
জিএম কাদের বলয়ের বাইরে থাকা নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদে বদনামের ভাগিদার হয়েছে জাতীয় পার্টি। পেয়েছে গৃহপালিত বিরোধী দলের পরিচিতি। এতে করে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও শুরু কিছুটা চাপমুক্ত ছিল জাপা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিপদ বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বৈঠক থেকেও বাদ পড়ে যায় দলটির নাম। শুধু তাই নয়, জিএম কাদেরসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও হয়েছে। সামনের দিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
নতুন বলয় তৈরির প্রক্রিয়ায় থাকা নেতারা বলছেন, জিএম কাদের নেতৃত্বে থাকলে আগামী নির্বাচনে লড়াই করাও কঠিন হয়ে যাবে। সেই আশঙ্কা থেকে তাকে বাইরে রেখে তারা দলের নেতৃত্ব তৈরির চেষ্টা করছেন।
এছাড়াও বড় ক্ষোভ হলো- গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে জিএম কাদের চেয়ারম্যান হিসেবে যখন যাকে ইচ্ছে বহিষ্কার, পদোন্নতি কিংবা যে কোনো ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। নেতারা এর অবসান চান।
জাপার একজন কো চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রেসিডিয়াম থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারা বেশিরভাগ এক জায়গায়। তারা সবাই জিএম কাদেরের বিপক্ষে। সবাই তার একনায়কতন্ত্রের অবসান চায়। এবার তেমন কিছু হতে যাচ্ছে।’
যদিও চেয়ারম্যান ছাড়া কারও কাউন্সিল করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘একটু পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কাউন্সিল তো রাস্তায় হতে পারে না। আর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলের সময়, সিদ্ধান্ত সব নেওয়ার ক্ষমতা চেয়ারম্যানের হাতে। সভাপতিত্বও তিনি করবেন। অন্য কেউ কাউন্সিল করলে তো সেটা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হবে না। বেআইনি হবে। আমরা চাই সবাই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে এক প্লাটফর্মেই থাকবেন।’
বিইউ/জেবি

