গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে দুই দফার বন্যায় ভাটা পড়ে বিএনপির রাজপথের কর্মসূচিতে। দলের নির্ধারিত কর্মসূচির মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ আছে সবকিছু। এর বাইরে চলছে ছাত্রদল-যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের যৌথ কর্মসূচি। এবার রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি সামনে রেখে জোরালোভাবে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। নভেম্বর মাসজুড়ে রাজধানী ঢাকাসহ জেলা ও মহানগরে নতুন করে গণসংযোগ ও সমাবেশের কর্মসূচি পালন করবে দলটি।
নির্বাচনের রোডম্যাপ চাওয়ার পাশাপাশি এসব কর্মসূচিতে দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি তোলা হবে বলে জানা গেছে। এর বাইরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে পরিচিত সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দফতরে থাকা কর্মকর্তাদের অপসারণের দাবিও তুলবেন নেতারা।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সভায় নতুন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে কর্মসূচি শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজেদের অবস্থান জানান দেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি তোলা হতে পারে এসব কর্মসূচিতে।
একই ধরনের কর্মসূচি দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদরে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোও করতে পারে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
দলীয় সূত্র জানায়, এসব কর্মসূচির মধ্যে এবারের ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালন করা হবে। এ উপলক্ষে ঢাকাসহ সারাদেশে জেলা ও মহানগরে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকায় বড় আকারে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা হবে। ৭ নভেম্বরকেন্দ্রিক কর্মসূচির পর অবস্থা বুঝে সাংগঠনিক কর্মসূচির গতি বাড়ানো-কমানো হবে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সদস্যরা রাষ্ট্র মেরামতে ঘোষিত সংস্কার কর্মসূচি এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দাবির বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে নিজেদের অবস্থান বদলাবে না দলটি। কারণ নেতাদের শঙ্কা, চাপ প্রয়োগ করে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করানো হলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হতে পারে।
ফলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হলেও সেখানে রাষ্ট্রপতির ইস্যুতে স্পষ্ট কোনো মতামত জানায়নি বিএনপি। উল্টো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তারেক রহমান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে সুচিন্তিতভাবে সিদ্ধান্ত নিলে ভবিষ্যতে অনেক জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হবে।’ দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও এই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অন্তবর্তীকালীন সরকার শুরু থেকে নানা চাপের মধ্যে থাকলেও আমরা সহযোগিতা করে আসছি। কিন্তু সংস্কারের নামে সময় যাচ্ছে, ভোটের বিষয়ে খুব চেষ্টা দেখছি না। এখন ভোটের জন্য চাপ প্রয়োগ না করলে আরও হয়তো লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে।’
বিএনপি নেতারা জানান, হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা এখনো রয়ে গেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় গ্রেফতারের ভয় না থাকলেও মামলা নিয়েই চলতে হচ্ছে। মামলা প্রত্যাহার নিয়েও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। তাই এই ইস্যুতেও জোরালো কথাবার্তা বলা হবে কর্মসূচি থেকে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সময়ক্ষেপণের অভিযোগ তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন, ‘সংস্কার করতে কতটুকু সময় দরকার হয় তা আমরা বুঝি। সে সময়টুকু পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। সেই সময়টুকু অতিক্রান্ত হলে বিএনপি অবশ্যই ঘরে বসে চিনা বাদাম খাবে না।’
আরও পড়ুন
অন্যদিকে পতনের পর একদম চুপচাপ থাকলেও মাঝেমধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সরব হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার অডিও বার্তায় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্য হালকাভাবে নিচ্ছে না বিএনপি। রাষ্ট্রপতি ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটি মহল আওয়ামী লীগকে মাঠে নামার সুযোগ নিতে পারে এমন আশঙ্কাও আছে নেতাদের মধ্যে। তাই দেশজুড়ে নেতাকর্মীদের সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় করার চেষ্টা করা হবে নতুন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে।
দেশজুড়ে কর্মসূচি ঘোষণা
কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগামী ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব উপলক্ষে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার এক যৌথ সভা শেষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জনগণের জন্য ৭ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ দিন। বর্তমান প্রজন্মকে এদিনের ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই ব্যাপকভাবে এই দিনের ইতিহাস ও গুরুত্ব ছড়িয়ে দিতে হবে। এ দিবসটি উপলক্ষে ১০ দিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের র্যালি ৮ নভেম্বর শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে।’
ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, ৭ নভেম্বর সকাল ৬টায় সারাদেশে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিকেলে শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ৬ নভেম্বর আলোচনা সভা। ৮ নভেম্বর রাজধানীতে র্যালি অনুষ্ঠিত হবে, এদিন জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে র্যালি হবে। এছাড়া অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন নিজেদের মতো আলাদা করে কর্মসূচি করবে। কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা করে জেলা পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করতে পারবে।
আরও পড়ুন
জানা গেছে, ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যাতে সক্রিয় উপস্থিতি থাকে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা তো মাঠেই আছি। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ভোটের জন্য অপেক্ষা করছে দেশবাসী। সেই নির্বাচন যাতে দ্রুত হয় সে দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরতে চাই। দেশজুড়ে এসব কর্মসূচি কখন, কোথায় হবে সে সিদ্ধান্ত শিগগিরই জানতে পারবেন।’
বিইউ/জেবি