- চাঁদাবাজি-দখলে নেতাকর্মীদের নাম আসায় বিব্রত হাইকমান্ড
- অপকর্মে নাম এলেই অ্যাকশন
- লম্বা হচ্ছে বহিষ্কার-অব্যাহতির তালিকা
- চাঁদাবাজি ঠেকাতে পাড়া-মহল্লায় নেতাদের টহল
- ‘নব্য বিএনপি’কে দুষছেন নেতারা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিতে বইছে স্বস্তির হাওয়া। প্রায় ১৬ বছর পর বাধাহীনভাবে চলছেন নেতাকর্মীরা। দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে একে একে মুক্তি পাচ্ছেন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রাজধানী থেকে তৃণমূল কোথাও পড়তে হচ্ছে না আওয়ামী লীগ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই কিছু কিছু নেতাকর্মীর দখল, লুটপাট-চাঁদাবাজিতে জড়ানোর খবর দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে বিএনপিতে। যা নিয়ে বিব্রত হাইকমান্ড।
বিজ্ঞাপন
অবশ্য শুরু থেকেই এ নিয়ে সতর্ক দলটির নীতি-নির্ধারকরা। অভিযোগ পেলেই নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থা। শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ এসব অভিযোগে এখন পর্যন্ত শতাধিক নেতাকর্মীকে করা হয়েছে বহিষ্কার।
দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিট পর্যায়ের নেতারাও মাঠের কর্মীদের বার্তা দিয়েছেন, অপরাধে জড়ানোর প্রমাণ পেলে রক্ষা নেই। ফলে শুরুর দিকে বেশি অভিযোগ এলেও ক্রমেই তা কমতে শুরু করেছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগের পতনে আপাতত তারা স্বস্তিতে আছেন। অনেকটা চাপমুক্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগশূন্য মাঠে অনেকটা এককভাবে চলার কারণে চাঁদাবাজিসহ অন্যায় অপকর্মে নেতাকর্মীদের নাম আসছে। তবে এদের বেশির ভাগই আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন না। এমন অবস্থায় দলের ইমেজ রক্ষা করতে ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
নেতারা মনে করছেন, মাঠ পর্যায়ে এসব বন্ধে যেভাবে তদারকি হচ্ছে তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হলে দিনশেষে তারাই বাহবা পাবেন।
বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সুবিধাবাদী শ্রেণির লোকজন খোলস বদলে এসব অপকর্ম করে তাদের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। কিছু কিছু অভিযোগ তদন্ত করে এমন প্রমাণও তারা পেয়েছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক ঢাকা মেইলকে বলেন, ’১৬ বছরের দুঃশাসনের পর মানুষ এখন মন খুলে চলছে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। কিন্তু বিএনপির নাম করে কেউ চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করলে কোনো প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। আমরা কিন্তু এ বিষয়ে বেশ কনসার্ন।’
কেমন অপরাধে জড়াচ্ছেন নেতাকর্মীরা
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে অস্থিরতা শুরু হয়। একই সময়ে আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা। দেখা নেই কর্মীদেরও। এই সুযোগে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কেউ কেউ দোকানপাট দখল, ভাঙচুর, ভয়ভীতি দেখানো, চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ আসতে থাকে কেন্দ্রে। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার অভিযোগও আসে কারও কারও বিরুদ্ধে।
এমন পরিস্থিতিতে অন্যায়-অপকর্মের বিরুদ্ধে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কঠোর বার্ত দেওয়া হয়। গত ৭ আগস্ট নয়াপল্টনের সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপির নাম ব্যবহার করে কেউ কোনো অপকর্ম করতে চাইলে তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হোক। সারা দেশে নেতাকর্মীদের সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপর একে একে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বিএনপি।
গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান ফকিরের আত্মীয় পরিচয়ে একজনের দোকান দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগকারী আবুল কাশেম জানান, এলাকার বাবুল মণ্ডলের কাছ থেকে দোকান কিনেছিলাম। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর সে বিএনপি নেতার আত্মীয় পরিচয় দিয়ে আমাকে বের করে দিয়ে দোকান দখলে নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহজাহান ফকির ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এই লোক আমার আত্মীয়। কিন্তু এমন কাজ করেছে সেটা জানি না। আমি খোঁজ নেব। এমন কাজ করে কেউ পার পাবে না। কারণ আমি দশ টাকাও খাই না এটা সবাই জানে।’
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বেশি আলোচনা হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের হামলা ও গুলির ঘটনা নিয়ে। এই ঘটনায় ঢাকার নিম্ন আদালতে মামলা হয়েছে। যেখানে আসামি করা হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নকে। অবশ্য এখনো তার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি যুবদল।
ভিন্ন ঘটনাও আছে। সম্প্রতি শ্রমিক দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব সুমন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ঘাট থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদা নেওয়ার কাজ করছেন মূলত ওখানকার একজন যুবলীগ নেতা। জাবের হোসেন পাপন নামের এই নেতা ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে শ্রমিক দল নেতা কোতয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
শতাধিক বহিষ্কার, বিপদে পড়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারাও
সূত্রমতে, গত ১৩ দিনে অন্তত ৯০ জন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন। তাদের মধ্যে যুবদলের অন্তত ৬০ জন রয়েছেন। এছাড়া ৫০ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও পদ স্থগিত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়া নেতারা ঢাকা মহানগর, বগুড়া, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, পঞ্চগড়, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, নোয়াখালী, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলার বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে পুকুর ভরাটের অভিযোগে বিএনপির বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে। যদিও তিনি এই অভিযোগ পুরোপরি অস্বীকার করেছেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য (দফতরের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত) সাইদুর রহমান মিন্টু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যেখানে অভিযোগ সেখানেই নেতারা ছুটে যাচ্ছেন। অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিএনপির আহ্বায়ক-সদস্য সচিবের ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে যে কেউ ফোন করতে পারছেন। এতে অপকর্মে জড়ানোর সাহস দেখাচ্ছে না। যে কারণে দক্ষিণে এখনো কেউ বহিষ্কার হয়নি।’
অপরাধে জড়ালে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না এমন বার্তা দিয়ে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব ও কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হক ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘কিছু অভিযোগ এলেও আমাদের সতর্ক দৃষ্টি আছে। ব্যবসায়ীদের বলে দিয়েছি এখন থেকে কাউকে চাঁদা দেবেন না। আমার দলের লোক হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে বলেছি।’
বিইউ/জেবি