* আধিপত্য বিস্তার, চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ঘটছে হত্যাকাণ্ড
* শক্তি বাড়াতে আওয়ামী লীগের লোকদের কাছে টানা হচ্ছে
বিজ্ঞাপন
* আওয়ামী লীগের এমপির সম্পদ রক্ষায় বিএনপি নেতা
* অন্যায় কাজে প্রশ্রয়দাতাদেরও বহিষ্কার: জেলা নেতৃবৃন্দ
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোটি টাকার মাছসহ ঘের হারান বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় নির্বাচন করা সালে আকরাম তসলিম। আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনার পতনের দিন দখলদাররা পালিয়ে গেলে নিজের ঘেরে ফিরে আসেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক তসলিম। কিন্তু মাত্র পাঁচদিনের মাথায় তাকে উচ্ছেদ করেন স্থানীয় বিএনপির এক পক্ষের লোকজন।
তসলিমের অভিযোগ, পাগলা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানার লোকজন তাকে তাড়িয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগের লোকজনকে মাছের ঘের বুঝিয়ে দিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
নিজ দলের নেতাকর্মীদের এমনকাণ্ডে দিশেহারা তসলিম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘নিজের দলের লোকজন আমার মাছের ঘের থেকে উচ্ছেদ করে আওয়ামী লীগের লোকদের বুঝিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে? যার লোকজন এটা করেছে সেই রানা ভাইকে একাধিকবার বলেছি, আমাকে আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু এখনো ঘেরের কাছে যেতে পারি না।’
আরও পড়ুন
শুধু তাই নয়, স্থানীয় সূত্র বলছে ক্ষমতার হাতবদলের সঙ্গে সঙ্গে হাতবদল হয়েছে গফরগাঁও-পাগলায় দখল, চাঁদাবাজির নেতৃত্ব। এখানে আওয়ামী লীগে সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেলের সময় থেকে চলা ত্রাসের রাজত্ব এখনও চলছে। পরিবর্তন হয়েছে নেতৃত্বের। এতে আতঙ্কের মধ্যে আছেন এখানকার সাধারণ মানুষ।
ইতোমধ্যে দখল, মাদকের নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এরসঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে একাধিক বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।
দুই উপজেলার নেতাদের ঢাকায় এনে জেলার নেতাদের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে কারও বিরুদ্ধে অন্যায়-অপকর্মে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দুই উপজেলা বিএনপি কমপক্ষে পাঁচটি গ্রুপে বিভক্ত। এসব গ্রুপের নেতৃত্বে জেলা বিএনপির সদস্য ও গফরগাঁও উপজেলার আহ্বায়ক এবি সিদ্দিকুর রহমান, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আক্তারুজ্জামান বাচ্চু, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আল ফাতাহ খান, গফরগাঁও উপজেলার যুগ্ম আহ্বায়ক মুশফিকুর রহমান, পাগলা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানা।
যদিও এদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ পুরো আমলে এলাকামুখী ছিলেন না। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার মিশনে নেমে দলকে বেকায়দায় ফেলছেন বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের লোকজনকেও কাছে টেনছেন কেউ কেউ।
এদের মধ্যে বিএসএমএমইউ’র চিকিৎসক ও পাগলা থানা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. মোফাখখারুল ইসলাম রানা ও গফরগাঁও উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবি সিদ্দিকুর রহমান, যুগ্ম আহ্বায়ক মুশফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, আওয়ামী লীগের অনুপ্রেবেশকারীদের কাছে টানা, এমনকি সাবেক এমপি বাবেলের সম্পদ পাহাড়া দেওয়ার অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীদের।
জেলা বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বললে তারাও এসব অভিযোগ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে আছেন বলে জানিয়েছেন। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী এসব অপকর্মে ইন্ধনদাতাদের বহিষ্কার করার কথা বলেছেন তারা।
ময়মনসিংহ জেলা বিএনপির ১ম যুগ্ম আহ্বায়ক জাকির হোসেন বাবলু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা দুই উপজেলার নেতাদের ডেকে কথা বলেছি। কয়েক জায়গায় বহিষ্কারও করা হয়েছে। পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে অপকর্ম বন্ধ না হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।’
জাকির হোসেন বলেন, ‘অনুপ্রবেশ ঘটানোসহ মোফাখখারুল ইসলাম রানার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এসেছে। তাকে সতর্ক করা হয়েছে। সে ১৫ দিনের সময় নিয়েছেন। দেখি কী পরিবর্তন ১৫ দিনে করেন। এরপর ঠিক না হলে ব্যবস্থা।’
বিএনপি নেতা বাবুল বলেন, ‘বাবেলের সম্পদ পাহারা দেওয়াসহ যেসব অভিযোগ মুশফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে এসেছে সেটা নিয়েও কথা বলেছি। তবে এখনো প্রমাণ পাইনি। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে নিজেদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিকবার কল করা হলেও মোফাখখারুল ইসলাম রানা ও মুশফিকুর রহমানকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে এ বিষয়ে প্রশ্ন পাঠালেও কোনো জবাব আসেনি।
কী হচ্ছে গফরগাঁও-পাগলায়?
মাছের ঘের বেদখল হওয়ার বিষয়ে ভুক্তভোগী সালে আকরাম তসলিম জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় বিএনপি কর্মী শাহজাহান ও হাতেম আলী খানের নেতৃত্বে একদল লোক এসে ঘের দখল করে নেয়। এরা সবাই ডা. রানার গ্রুপের লোক।
অভিযোগ আছে, শাহজাহান একাধিক মাদক মামলার আসামি। বেশ কয়েকবার জেলও খেটেছেন। তার নেতৃত্বে স্থানীয় বামনখালীর বটতলা বাজারে অনিক টেলিকম ও মিষ্টির দোকানে ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। শুধু তাই নয়, পলাশ নামে স্থানীয় এক বিএনপি কর্মীর খামারের মাছ ও মুরগি বিক্রি করে দিয়েছেন শাহজাহান ও তার লোকজন। এছাড়াও বিএনপির আব্দুল হামিদ, বশির মণ্ডল, শহীদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি-দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে গত ৮ আগস্ট গফরগাঁওয়ে আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে পৃথক ঘটনায় জসিম ও সবুজ নামে দুইজন নিহত হন। এরা এলাকায় চিহ্নিত মাদক চোরাকারবারি হিসেবে পরিচিত।
তথ্যমতে, ৫ আগস্টের পর গফরগাঁও বাজারের ব্যবসায়ী বারী প্লাজার মালিক আসাদুর রহমানের থেকে নিহত জসিম ১২ লাখ টাকা চাঁদা নেন। সেই টাকা ভাগাভাগি নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
অভিযোগ আছে, গফরগাঁও পৌর বিএনপির সদস্য জয়নাল আবেদিন চানু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল টাকা চাঁদাবাজি করেছেন। এ নিয়ে প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে বিএনপি নেতা চানু।
চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে গফরগাঁও উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মুক্তার হোসেনের বিরুদ্ধেও। যুবলীগ নেতা তাজমুন আহম্মেদের মাদক ব্যবসা এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন মুক্তার। অন্যদিকে পাগলা থানা বিএনপির সদস্য কবির সরকার, ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার হোসেন শাওন, রফিকুল ইসলাম ওরফে কাইল্লা রফিকের নেতৃত্বে কান্দিপাড়া বাজারে দিনেদুপুরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনা ঘটে। স্থানীয় আসকর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের মার্কেট দখল করে তালা লাগিয়ে দেয় এরা। উচ্ছেদ করা ভাড়াটিয়াদের। এই ঘটনায় ইতোমধ্যে কবির সরকার ও তার ছেলে শাওনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বিষয়ে সিরিয়াসলি পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের কাজগপত্র তৈরি করা আছে। অপকর্ম করলেই বহিষ্কার।’
বিইউ/এমআর