- এলাকায় ফিরে ফের আত্মগোপনে নেতাকর্মীরা
- তৃণমূলের নেতারা পালিয়ে ঢাকায়
- রাতে বাসায় অবস্থান করছেন না স্থানীয় নেতাকর্মীরা
- নেই কোনো নির্দেশনা, অন্ধকারে তৃণমূল
টানা ১৫ বছর ৭ মাস ৬ দিন একচ্ছত্র ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন করেন শেখ হাসিনা। গড়ে তোলেন এক শক্তিশালী বলয়। সেই বলয় কেউ ভেদ করতে পারে, এমন ধারণাও ছিল না আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কারও। তবে তেমনটাই হয়েছে গত ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সেদিন পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে অসহনীয় দুর্ভোগ। পঁচাত্তরের পর দেশের সবচেয়ে পুরনো এই দলটি এত বড় বিপর্যয়ে আর পড়েনি।
বিজ্ঞাপন
শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান দলটির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সবাই৷ গা ঢাকা দেন তারা। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ও কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেফতার হন। কেন্দ্রীয় ও হ্যাভিওয়েট নেতাদের দিকে যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর, তখন অনেকটাই চিন্তামুক্ত হয়েছিলেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
৫ আগস্ট নিজ নিজ এলাকা ত্যাগ করা নেতাকর্মীদের অনেকেই বাড়িঘরে ফেরা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় বাড়িয়ে দেয়। এতে আতঙ্ক বিরাজ করছে থানা, ওয়ার্ড, ইউনিট পর্যায়ের নেতা, এমনকি কর্মীদের মাঝেও। তারা এখন কী করবেন, কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন সে ব্যাপারে নেই কোনো নির্দেশনাও। এতে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে ক্ষোভও।
তৃণমূলে চলছে ধরপাকড়
বিজ্ঞাপন
রোববার (৬ অক্টোবর) রাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলার ঘটনায় তাকে গ্রেফতার করা হয়৷ একই রাতে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় অভিযান চালিয়ে উপজেলার পাটগাতী বাজারের সোনালী ব্যাংক ভবনের তিনতলা থেকে আটক করা হয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম তৌফিক ইসলামকে।
ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে পাঁচ আওয়ামী লীগ নেতাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে চারজনকে দাগনভূঞার সমাসপুর এলাকা থেকে এবং একজনকে ফুলগাজী থেকে শনিবার দিবাগত রাতে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- ফুলগাজী উপজেলার মধ্যম শ্রীচন্দ্রপুর গ্রামের তাজুল ইসলামের ছেলে আলমগীর খন্দকার (৫০), দাগনভূঞার সমাসপুর গ্রামের সোলেমান কোম্পানি বাড়ির মীর হোসেন সোহাগের ছেলে আমির হোসেন জাহেদ (২১), একই গ্রামের আবদুল মজিদ বাড়ির আবদুস ছাত্তারের ছেলে আব্দুল হানিফ (১৯), পাটোয়ারী বাড়ির সিরাজুল হকের ছেলে নুর নবী (৪০) ও গাজী পাটোয়ারী বাড়ির রহমত আলীর ছেলে আব্দুল রাজ্জাক (৫০)।
গত ৪ আগস্ট সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পুরাতন বাস-স্টেশন এলাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় একদিনে আওয়ামী লীগের ১১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার মামলায় গ্রেফতার ১১ জন হলেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণ শ্রী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. ফখরুল মিয়া তালুকদার, দোয়ারাবাজার উপজেলার সদর ইউনিয়নের যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. খসরু মিয়া, স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আলী আকবর, উপজেলার সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছদরুল হক, শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক মজিবুল রহমান রিপন, শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক মো. লুৎফুর রহমান, জগন্নাথপুর পৌর আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শুকুর আলী ভূঁইয়া, জামালগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আবুল আজাদ, ছাতক উপজেলার ছৈদেরগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব মোখলেছুর রহমান, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আ. ছালাম ও মো. বকুল মিয়া।
একই ধরনের অভিযান চলছে রাজধানীতেও। রোববার ধানমন্ডি থানা পুলিশ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হামলা চালানোর অভিযোগে শাকিল হোসেন নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি। তাকে হাজারীবাগ থানার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়।
তৃণমূলের নেতাকর্মীদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতারে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সরকার পতনের পর গা ঢাকা দেওয়া নেতাকর্মী যারা নিজ এলাকায় ফিরতে শুরু করেছিলেন, তারা আবার পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
আতঙ্কিত তৃণমূল, নেই নির্দেশনাও
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে, ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের একজন কর্মী ঢাকা মেইলকে জানান, আগস্টে গা ঢাকা দেওয়ার পর সেপ্টেম্বরে এলাকায় ফিরেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এখন তারা আতঙ্কিত৷ ফলে আবারও ঘর ছেড়েছেন।
মোহাম্মদপুর থানার অন্তর্ভুক্ত একটি ইউনিয় আওয়ামী লীগের একজন কর্মী পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমাদের তো কমিটিই আন্দোলনের আগে বিলুপ্ত করে দিলো। আমরা তো ঝামেলায়ও ছিলাম না। যেভাবে অভিযান চলতেছে, তাতে তো বাসায় থাকতে পারতেছি না।'
বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেত্রী ঢাকা মেইলের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, 'আমার আসলে যাওয়ার জায়গা নাই। আমি কিছুই করি নাই। কারও দুই টাকা খাইও নাই৷ কাউকে মারিও নাই। এটা সবাই জানে। আমি আমার বাসাতেই আছি। কিন্তু আতঙ্ক আছে।'
আতঙ্ক বিরাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের মধ্যে। এরইমধ্যে জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই দেশ ছেড়েছেন। তবে সুযোগের অভাবে দেশে রয়ে গেছেন, এমন কাউন্সিলররা আছেন আতঙ্কে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের একজন কর্মী ঢাকা মেইলকে বলেন, 'আমার তো কোনো পদ নাই। মারামারিতেও ছিলাম না। কিন্তু মামলা দিছে। কয়েক দিন বাসায় ছিলাম। এখন বাসায়ও থাকতে পারতেছি না।'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রেফতার এড়াতে এক জেলার নেতারা আরেক জেলায় অবস্থান করছেন। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ঢাকায় রয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একজন আত্মীয় এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি জানিয়েছেন, এলাকায় ফেরার কোনো উপায় নেই। প্রতিদিনই পুলিশ বাড়িতে হানা দিচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি ওবায়দুল কাদেরের এক ভগ্নিপতিকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে। এতে তারা এলাকায় ফেরার সাহস করছেন না।
এদিকে গভীর সংকটে পড়া ঐতিহ্যবাহী দলটির কেন্দ্র থেকে নিয়ে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত পুরো সংগঠন অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রকাশ্যে কোনো তৎপরতা নেই। এমনকি নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনাও পাচ্ছেন না কর্মীরা। এতে ক্ষোভ রয়েছে অনেকের মধ্যে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ময়মনসিংহ অঞ্চলের একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দলকে ডুবিয়েছে একটি চক্র, কিছু চিহ্নিত মানুষ। কিন্তু ভুগতে হচ্ছে আমাদের সবার। আমরা যারা দুর্নীতি করিনি, কারও পেছনে লাগিনি, তারাও একের পর এক মামলার আসামি হচ্ছি। আমরাও বাড়িতে থাকতে পারছি না। অথচ দলের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে না। জানি না, এভাবে কত দিন চলবে। আর আমরাই কত দিন টিকে থাকতে পারব।
কারই/জেবি