জোট-মহাজোটের শরিকদের নিয়ে গত তিনটি নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তিনটি নির্বাচনেই দলটি আশাতীত সফলতা পেয়েছে। তবে এবার যে নির্বাচনটি দরজায় কড়া নাড়ছে সেটির চরিত্র গত তিন নির্বাচনের চেয়ে ভিন্ন। প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করেছে। এই অবস্থায় নির্বাচনের মাঠে ভোটের আমেজ ধরে রাখাই এখন ক্ষমতাসীন দলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
এ কারণে আওয়ামী লীগ গত তিন মেয়াদের মতো ঘোষণা দিয়ে জোট-মহাজোটে নির্বাচন করতে চাচ্ছে না। আবার শরিকদের পুরোপুরি বঞ্চিতও করতে চাচ্ছে না। এজন্য আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে শরিকদের পক্ষ থেকে চাপ থাকলেও এ ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিজ্ঞাপন
দেশের প্রায় সব আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থিতায় ঘোষণা করায় ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে কিছুটা হতাশা কাজ করে। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জোটনেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার (৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গণভবনে দীর্ঘ বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে কিছু আসনে শরিকদের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয় আওয়ামী লীগ। তবে কোন আসনে কীভাবে ছাড় দেওয়া হবে সেটা নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমু মঙ্গলবার (৫ ডিসেম্বর) জোটের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে জোট নেতারা আসন ভাগাভাগির বিষয়টি দ্রুত শেষ করার তাগিদ দেন। তবে আমির হোসেন আমু সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আগামীকাল বুধবার (৬ ডিসেম্বর) জাতীয় পার্টির সঙ্গে বৈঠক করবে আওয়ামী লীগ। এরপর সবার দাবি-দাওয়া সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হবে। আসন ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত হবে ১৭ ডিসেম্বর।
বিজ্ঞাপন
আমু সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় পার্টির সাথে কালকে আলাপ হবে, আলাপ হওয়ার পর একটা পর্যায়ে যেতে পারে। কিছু কনফ্লিক্ট হতে পারে, তা দেখতে হবে, জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ, ১৪ দল- কনফ্লিক্ট হয় কি না, সেটা দেখতে হবে।’
আমু বলেন, ‘বিগত দিনে আমরা এক সঙ্গে নির্বাচন করেছি। নির্বাচন ও আন্দোলন এক সাথে করি। আমরা এখনো বলছি, আমাদের নির্বাচন এক সাথে হবে। আমাদের ১৪ দল জোটগতভাবে নির্বাচন করব। সেই সিদ্ধান্তে আমরা অটুট রয়েছি।’
১৪ দলের সমন্বয়ক বলেন, ‘আসনের ব্যাপারে কোথায় কী করা যায়, কীভাবে আসন বিন্যাস করা যায়, যার যার মতো করে যদি বলে, সে ব্যাপারে আমরা আলোচনা করছি। সে আলোচনা করে আমরা নেত্রীকে জানাব। আজকে মেনন সাহেব, ইনু সাহেব এসেছেন, আলোচনা হয়েছে; আমি কালকে সেই বিষয়গুলো নেত্রীকে জানাব। আলাপ করার পর আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব।’
কৌশলী আওয়ামী লীগ
সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ মূলত এক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে। শরিকদের পক্ষ থেকে চাপ থাকলেও আসন ভাগাভাগির বিষয়টি তারা এখনই চূড়ান্ত করতে চাচ্ছে না। জাতীয় পার্টির সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয় রয়েছে। কিছু আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় না দিলে শেষ পর্যন্ত দলটি বেঁকে বসতে পারে। এজন্য যেকোনো মূল্যে জাতীয় পার্টিকে ভোটের মাঠে ধরে রাখতে চাইবে ক্ষমতাসীন দল। এক্ষেত্রে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের নিয়ে খুব একটা ভাবছে না আওয়ামী লীগ। কারণ, তারা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সঙ্গেই থাকবে- এমনটা ধারণা দলটির।
সূত্র জানিয়েছে, জোটের শরিক দলগুলো এবার ২০১৪ সালের মতো আসন বিন্যাস চায়৷ ঢাকাসহ সারাদেশে তারা আসন চাচ্ছে ২৫ থেকে ২৬টি। যদিও সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত চারটি আসনে ১৪ দলীয় জোটকে ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননকে বরিশাল-২ অথবা বরিশাল-৩, জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে পিরোজপুর-২, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে কুষ্টিয়া-২ ও তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে চট্টগ্রাম-২ আসনে ছাড়ের সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন।
জানা গেছে, সাধারণ আসন না পেলেও জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার পেতে পারেন সংরক্ষিত মহিলা আসন৷
সূত্র জানিয়েছে, জোটের শরিক অথচ তাদের দলের কেউ একাদশ সংসদে কেউ এমপি ছিলেন না, এমন দলও এবার আসন চাচ্ছে।
আমুর সঙ্গে বৈঠক শেষে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ঢাকা মেইলকে জানান, জোটের আসন বিন্যাসের বিষয়টি দ্রুত করার তাগিদ দিয়ে গেছেন তারা৷ ইনু বলেন, 'আমরা এমনিই সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। টুকিটাকি আলোচনা করে এলাম। যাতে উনি (আমির হোসেন আমু) আসন বণ্টনের কাজটা দ্রুততার সঙ্গে শেষ করেন। আমরা আশা করছি, তিন-চার দিনের ভেতরে এটা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে৷'
১৪ দলের আসন বণ্টনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইনু বলেন, 'যে কোনো আসন বণ্টনে একটা দরকষাকষি হয়, মন কষাকষি হয়। এরপর একটা সমঝোতা হয়। এটা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নাই।'
সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ইতোমধ্যে ২৮৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। তবে দলটি কিছু আসনে ছাড় চায়, যাতে যেসব আসনে নিশ্চিত বিজয়ের মাধ্যমে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা ধরে রাখতে পারে। এজন্য দলটি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দর কষাকষি করছে। আগামীকালের বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় পার্টিকে দেশের বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি ঢাকায় দুটি আসনে ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। আসনগুলো হলো ঢাকা-৪ ও ঢাকা-৬। দুটি আসন বর্তমানে জাতীয় পার্টির দখলে রয়েছে। আওয়ামী লীগ আসন দুটিতে প্রার্থী ঘোষণা করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের বসিয়ে দেওয়া হতে পারে।
এদিকে এবারের নির্বাচনে তৃণমূল বিএনপি, কিংস পার্টি খ্যাত বিএনএম, জেনারেল (অব.) ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি, কয়েকটি ইসলামি দল আওয়ামী লীগের আশ্বাসে ভোটে অংশ নিয়েছে। তাদেরও ছাড় দেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা জানান, বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করায় একতরফা ভোটের যে বদনাম সেটা ঘোচাতে চায় আওয়ামী লীগ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেন কেউ বিজয়ী না হতে পারে সেজন্য দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেওয়া হলেও নেতাদের জন্য ভোটের সুযোগ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়া যারা নির্বাচনে এসেছে তারা যেন শেষ পর্যন্ত থাকে এবং নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় সেই চেষ্টা থাকবে আওয়ামী লীগের।
তবে আসন ভাগাভাগি প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেবেন বলে জানান ওই নেতা। তিনি জানান, দলীয় প্রধান শরিক বা জোটের কাউকে ছাড় দিলে সেখানে আর কারও করার কিছু থাকবে না।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জোট প্রসঙ্গে বলেন, আমাদের সিদ্ধান্ত ১৪ দলীয় জোটগতভাবেই আমরা নির্বাচন করব। আমাদের কাছে শরিকদের সবসময় গুরুত্ব আছে, সেজন্য জোটগতভাবে আমরা নির্বাচন করছি। আমাদের এককভাবে নির্বাচন করার শক্তি, ক্ষমতা, সমর্থন আছে, কিন্তু শরিকদের গুরুত্ব দেওয়া হয় বিধায় আমরা জোটগতভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
২০০৮ সালে প্রথমবার জাতীয় পার্টিসহ মহাজোট নিয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সেই নির্বাচনে ব্যাপক সফলতা পায় দলটি। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট বর্জন করায় জাতীয় পার্টি জোটে ছিল না। তবে তখন ৩৪টি আসনে প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। সেসব আসনেই জয় পায় জাতীয় পার্টি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। তবে দলটি জয় পায় ২৩টিতে।
গত নির্বাচনে ১৪ দলের শরিকদের ১৬টি আসনে ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে ১৪টিতে প্রার্থীরা ভোট করে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায়, জাতীয় পার্টির (জেপি) দুইজন প্রার্থী তাদের দলীয় প্রতীক বাইসাইকেল নিয়ে ভোটে অংশ নেন।
কারই/জেবি