আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশে উত্তপ্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে সরব বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা সরকারবিরোধী দলগুলো। এসব দলের নেতাকর্মীরা যখন আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় ঠিক তখনই দেশব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বাড়িঘরে হামলা করছে দুর্বৃত্তরা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সরকারবিরোধী আন্দোলনে সরব দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে। এসব হামলায় সরকারকে দায়ী করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন— বিএনপি বিহীন নির্বাচন নিষ্কণ্টক করতেই এই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা।
এরমধ্যে গত মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ করেছে দুর্বৃত্তরা। মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস অভিযোগ করেছেন, ককটেল নিক্ষেপের পর পুলিশের সহায়তায় ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়েছেন হামলাকারীরা। একই দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতে হামলার ঘটনা ঘটে সিলেটের সদ্যবিদায়ী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বাড়িতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, আরিফুল হকের বাড়িতে ককটেল নিক্ষেপ করে দৌড়ে পালাচ্ছেন হামলাকারীরা।
বিজ্ঞাপন
এদিকে একই কায়দায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা তরিকুল ইসলামের যশোরের বাড়িতেও। শুধু ঢাকা, সিলেট ও যশোর নয়, হামলা ও লুটপাটের খবর পাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জ ও নোয়াখালী থেকেও। জানা যায়, বুধবার নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু বিএনপি নেতার বাড়িতে হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
মোহাম্মদ আলী মাহমুদ। তিনি সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আরিফুল হক চৌধুরীর বাড়িতে হামলার ঘটনায় কেউ অভিযোগ করেনি। মামলাও হয়নি এই ঘটনায়। ফলে এ ঘটনায় কাউকে আটক বা ঘটনার তদন্ত করার সুযোগও তাদের হয়নি।
নোয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম বলছেন, বিএনপি নেতাদের বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় আমাদের কাছে তো কেউ কোনো অভিযোগই করেনি। অভিযোগ না করলে কীভাবে জানবো আমরা।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত কিছুদিনে নারায়ণগঞ্জে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা হয়েছে। ভুক্তভোগী নেতাদের অনেকেই জেলে রয়েছেন। কেউ কেউ রয়েছেন আত্মগোপনে। এতে যেসব নেতা আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বিএনপির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে কয়েকটি জেলায় দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে।
চোরাগোপ্তা হামলা কেন?
নির্বাচন কমিশন (ইসি) ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি নেতাদের দাবি— দিনটিকে সামনে রেখে এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এর প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই যেন নির্বিঘ্নে নির্বাচনের দিনটি পার করা যায়।
সেলিমা রহমান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। তার মতে— নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন নিপীড়নের এটি আরেকটি প্রক্রিয়া মাত্র। তিনি বলেন, আমাদের আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। এটি নতুন ধরনের নিপীড়ন, যার মূল উদ্দেশ্য হলো বিরোধী দল বিহীন নির্বাচনকে নিষ্কণ্টক করা।
অর্থাৎ বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের কোনো বিরোধিতা যেন না দেখা যায়, সেটি নিশ্চিত করতেই আটক ও আত্মগোপনে থাকা নেতাদের বাড়িঘরে হামলা বা ককটেল নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটছে।
সেলিমা রহমানের মতে— জেলে থাকা সিনিয়র নেতাদের বাড়িঘরও টার্গেট করা হচ্ছে। আন্দোলনকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য, যাতে করে কেউ আটক হলে অন্য কেউ নেতৃত্ব গ্রহণে এগিয়ে না এসে।
তবে বিএনপির এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে হামলা ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনাগুলোর জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি বলেছেন, এ ধরনের চোরাগোপ্তা হামলা তো অনেকদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত করে আসছে। এখন এগুলো ঘটিয়ে তারা তাদের বিদেশি প্রভুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। সবই তাদের সাজানো নাটক।
আরও পড়ুন
তিনি দাবি করেন— হরতাল-অবরোধের মাধ্যমে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে না পেরে এখন চোরাগোপ্তা হামলার পথ বেছে নিয়েছে বিরোধীরা। তাদের মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনকে সামনে রেখে ভীতির পরিবেশ তৈরি করা। তিনি বলেন, কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না। পুলিশ প্রশাসন দুষ্কৃতকারীদের ধরছে। দল হিসেবে আমরাও সতর্ক আছি। বিএনপি কোনোভাবেই একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও উৎসবমূখর নির্বাচনের পরিবেশকে অশান্ত করে তোলার সুযোগ পাবে না।
মানবাধিকার সংগঠক ও বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলছেন, ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে তার কাছে মনে হয়েছে, যারাই করছে- এর মূল উদ্দেশ্যই হলো ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করা। তিনি বলেন, এক সাথে অনেক ধরনের ঘটনা দেখছি আমরা। সামনে নির্বাচন। বিরোধী দল রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে আটক ও পালিয়ে থাকা নেতাদের বাড়ি টার্গেট করে হামলা হচ্ছে। অনেককে আটকের পর মারধর করে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে বিষয়টি নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত।
এই বিশ্লেষক আরও বলেন, গেল ২৮ অক্টেবর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। তিনি মনে করেন, হঠাৎ করে বিরোধী নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে ককটেল নিক্ষেপ কিংবা তাদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলাগুলোর সঙ্গে এর যোগসূত্র থাকতে পারে। সূত্র: বিবিসি
এইউ