রোববার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ঢাকা

পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশ: বিরোধী রাজনীতিবিদরা কী বলছেন?

মুহা. তারিক আবেদীন ইমন
প্রকাশিত: ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:১১ এএম

শেয়ার করুন:

Special
কোলাজ: ঢাকা মেইল

বিশ্বের ৩৩তম দেশ হিসেবে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারীদের খাতায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্যদিয়ে পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশ, দেশের জন্য বড় মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপস্থিতিতে বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকেল ৩টা ৫২ মিনিটে ভার্চুয়ালি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ঐতিহাসিক এ ঘটনার সাক্ষী হতে অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসিও।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বৃহৎ প্রকল্প। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে সরকারের ব্যয় ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। আর ২০২৫ সালের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট চালু হতে পারে। পুরোপুরিভাবে দুটি ইউনিট চালু হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। ইতোমধ্যেই প্রথম ইউনিটের ভৌত এবং অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়ে গেছে ৯০ শতাংশের বেশি। আর দ্বিতীয় ইউনিটের কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ।


বিজ্ঞাপন


Special1
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ফাইল ছবি

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যখন এটি নিয়ে বেশ উৎফুল্ল, তখন পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিরোধী দলের রাজনীতিবিদরা। তারা বলছেন, বৃহৎ এই প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। অনেকেই আবার বলছেন, এখানে যে দুর্নীতি হয়েছে। যখন সারাবিশ্বই নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, তখন বাংলাদেশের পারমাণবিকের দিকে যাওয়াটা বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, ঘনবসতি ও জীবন প্রকৃতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ভাষ্য- এটা সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত। দেশের জন্য ক্ষতিকর। এতে করে পরিবেশের পাশাপাশি মানুষের শারীরিক সমস্যা বাড়বে। বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দুর্নীতি করতেই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প করা হয়েছে। সরকার কোনোরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রেখে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করেছে।’


বিজ্ঞাপন


নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টের ‘বিরূপ প্রভাব’ নিয়ে উদ্বিগ্ন বিএনপির আরেক নেতা ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খানও। তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি এর পেছনে ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। কিন্তু আমি দুঃখের এবং যথেষ্ট যুক্তি দিয়ে বলছি যে, অর্থনীতিবিদরা আমার সঙ্গে তর্ক করতে পারেন যে, এ ১৩ বিলিয়ন ডলার তো জলে গেল। আমি জোর দিয়ে বলছি- এই ১৩ বিলিয়ন ডলার যদি জলে না যায়, তাহলে তার ফলশ্রুতিতে যে ক্ষতি হবে বা হতে পারে অথবা বাংলাদেশে যে পরিবেশগত বিপর্যয় হতে পারে তার মূল্যমান ১৩ বিলিয়ন ডলার না হয়ে ১৩০ বিলিয়ন ডলার হলেও কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই।’

 

আরও পড়ুন

স্মার্ট বাংলাদেশের আরেকটি পদক্ষেপ: প্রধানমন্ত্রী

বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেন, ‘আজকে আমরা পৃথিবীতে যদি কেবল অর্থ-বিত্ত সম্পদ এগুলোর পেছনে ছুটি, যদি আমরা দেশের দরিদ্র মানুষের যে কোয়ালিটি অব লাইফ, তাদের যে স্বাস্থ্য, তাদের যে নিরাপত্তা- সেগুলো যদি ভুলে যাই, তাহলে কিন্তু আমরা আমাদের মরার অথরিটি হারিয়ে ফেলব। যেটা আজকের সরকার হারিয়ে ফেলেছে। তাদের এই দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকার আর কোনো নৈতিক অধিকার নেই। তারা একে একে ভুল করে যাচ্ছে। আর তাদের সর্বশেষ ভুল সেটা হচ্ছে এই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। আমি বিনীতভাবে এ সরকারকে অনুরোধ করব- এই আগুন নিয়ে খেলার পথ থেকে আপনারা সরে আসুন।’

 

ইউরেনিয়াম হস্তান্তর ও পারমাণবিক যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে ইউরেনিয়াম লাগবে- এটা খুব স্বাভাবিক একটা জিনিস। এটা আহামরি তেমন কিছু না। আর এই প্রকল্প আজকের না। এটা প্রায় ৫৬ বছর আগের। ৫৬ বছর আগের প্রকল্প এখন আংশিক সমাধানের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এটার উন্নয়ন বা সমাধান করতে দিয়ে যে দুর্নীতি হয়েছে, যে ওভার প্রাইজিং হয়েছে দুর্নীতিটাই একটা বড় ইস্যু।’

প্রায় একই কথা জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘কতগুলো জ্বালানি ট্রান্সফার করার মধ্যদিয়ে পরমাণুর যুগে প্রবেশ করা বলে না। পরমাণু যুগে প্রবেশ করা মানে আমি যদি একটা পারমাণবিক শক্তি হই, সেরকম কোনো জায়গাতে যাওয়া। একটা বিদ্যুতের প্লান্ট করে আমি পারমাণবিক যুগে যেতে পারি- তা না। আবার এটাও ঠিক যে এটা দিয়ে একটা পথ শুরু করা যায়। কিন্তু যে প্রজেক্টের মাধ্যমে এটা করা হচ্ছে এটার মধ্যে যে দুর্নীতিটা হচ্ছে, এটা আমরা আগেও অনেকবার বলেছি, এটা যে ১২৩ হাজার কোটি টাকা, তামিলনাড়ুতে একই প্রকল্প তারা বাস্তবায়ন করেছে ৩৩ হাজার টাকায়। সে হিসেবে কত বড় ডিস্টেন্টস একবার খেয়াল করেন।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি বলেন, ‘আমি বলব- এটা চুরি করার ধান্দা, আর বলছে আমরা অ্যাটমিক যুগে প্রবেশ করলাম। দুইটা ইউরেনিয়াম পেলেই কি কেউ বলতে পারে, আমরা আণবিক যুগে প্রবেশ করলাম। এটা যদি একটা অনেস্ট প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেত, তবে এর বিরুদ্ধে হয়তো আমি নিজেও কথা বলতাম না।’

 

আরও পড়ুন

বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ বাংলাদেশ

গণতন্ত্র মঞ্চের আরেক শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এই প্রকল্পকে ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘ক্রমান্বয়ে যারা টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ, মানসিক জীবন- এসব ব্যাপারে সংবেদনশীল, তারা পর্যায়ক্রমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা করাটা ছিল খুবই বিস্ময়কর। আমি আগেও বলেছি, এটা অনেকটা গরিবের ঘোড়া রোগের মতো এবং সারা দুনিয়ার যে অভিজ্ঞতা, সেটা রিসেন্টলি অনেকগুলো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা রয়েছে। এটা শুধু চেরনোবিল নয়, জাপানের ফুকুশিমায় যে ঘটনা ঘটেছে, আমাদের বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, আমাদের এখানকার ঘনবসতি, মানুষ তার জীবন-প্রকৃতি এটা আমাদের জন্য প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ।’

 

সাইফুল হক বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রকল্প। এসব প্রকল্পের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন আছে। এটার দায়-দেনা শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষকেই বহন করতে হবে। এখন সারাবিশ্বেই যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, সেগুলোতে আমাদের যাওয়ার সুযোগ ছিল।’

অপরদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র ও দলটির যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। ঢাকা মেইলকে তিনি বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে মানুষ উপকৃত হবে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এসব নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতেও তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়েছে, সেখানে আমাদের দেশে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার- এসব নিয়েও প্রশ্ন আছে। এর মাধ্যমে বুঝা যায় এর পেছনে দুর্নীতির একটা বড় ঘটনা ছিল। বড় প্রোজেক্ট এবং এখানে বড় দুর্নীতি করার জন্যে এখানে সরকার উৎসাহিত হয়েছে কিনা এটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শুধু এটাই নয়, বড় বড় যে সমস্ত প্রোজেক্ট হচ্ছে সবগুলোতেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে আমরা দেখছি। এখন এটা আমাদেরকে সাফার করতে হবে। আমরা দেখছি, রিজার্ভের অবস্থাও ভালো না। এটা তো আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে হয়নাই। বিভিন্ন ঋণ-টিন নিয়ে হয়েছে। এখন আমাদের তো এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আমরা অবশ্যই খুশি হতাম যদি স্বচ্ছতার সাথে এটা বাস্তবায়ন হতো।’

টিএই/আইএইচ

ঢাকা মেইলের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

সর্বশেষ
জনপ্রিয়

সব খবর